শুধু একটি মারাত্মক, জীবনমরণ সমস্যার ব্যাপারে, সৃষ্টির সেই আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি।
তুমি কি আমায় ভালোবাসো? এ প্রশ্নটি শুধোবার বেলা পুরুষানুক্রমিক ঐতিহ্য কোনও প্রাণীরই রত্তিভর কাজে লাগে না, এমনকি সমসাময়িক প্রতিবেশী, অন্তরঙ্গ ইয়ারদোস্তের উদাহরণ দিকনির্দেশ সম্পূর্ণ বেকার, বেফায়দা। দাদা আদমের আমল থেকে আজ পর্যন্ত তথা ভুবনবিখ্যাত মহাপুরুষরাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, মহাপ্রলয়ের পর নবসৃষ্টির প্রারম্ভেও মানুষ ওই প্রাচীনতম প্রশ্নটি শুধোবার সময় সেই প্রথমদিনের মতো বিলকুল হাবা বনে যাবে, কাতরাতে কাতরাতে যেসব ধ্বনি প্রকাশ করবে সেগুলো একদম সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কনফার্মড রাম-ইডিয়টের গোঙরানোর মতো।
ওদিকে আবার শিপ্রার চরিত্র বিচিত্র। এমনিতে মনে হয় সে আর পাঁচটা টপ ক্লাস সোসাইটি গার্লেরই মতো- গার্ল বললে স্বল্লোক্তি হয়, লেডি বললে আবার অতিশয়োক্তি হয়ে যায়। আজ চিত্রপ্রদর্শনীর দ্বারোঘাটন, কাল প্রধানমন্ত্রীকে মাল্যদান এসব কোনওপ্রকারের সামাজিক, রাজনৈতিক কর্তব্যকর্ম করতে সে সম্পূর্ণ বিমুখ যদিও দেশে এবং বিদেশে লেখাপড়াতে সে অসাধারণ না হলেও ডিবেটে ছিল অত্যুত্তম, উচ্চারণ ন্যাকামিবর্জিত। দোষের মধ্যে ছিল স্মার্ট সেটের মতো সে ট্যারচা ট্যারচা বাঙলা বলতে পারত না।
তার আসল বৈশিষ্ট্য ছিল আলাপ-আলোচনার সময় মারাত্মক সব অভিমত প্রকাশ করে স্মার্টেস্ট সেটকেও হাজার ভল্টের শক দেওয়া। পবিত্র, শাস্ত্রীয়, আচারসম্মত এ ধরনের শব্দ তার অভিধানে ছিল না, কারণ তার পিতাই সেগুলো স্বহস্তে মুছে সাফ করে দিয়েছিলেন।
তদুপরি তার সঙ্গে প্যারিস-লন্ডন করার পর কোনও জিনিস বা লজি আঁকড়ে ধরার মতো মনোবৃত্তি তার আর ছিল না। সামাজিক আচরণে কাউকেই খুব বেশি কাছে ঘেঁষতে দিত না, আবার হট যাও হট যাও সায়েবিয়ানা সে ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে কখনও দেখেনি বলে সে গন্ধ তার গায়ে ছিল না। কৈশোরে পুরো একটি বছরের অধিকাংশ সময় কেটেছে প্যারিসের লক্ষ্মীছাড়া লঝঝড়ে গরিব পেন্টারদের সঙ্গে। সাম্যবাদ ফ্রানসের পার্লিমেন্টে মূলমন্ত্র বটে কিন্তু তার পরিপূর্ণ সপ্রকাশ দেখতে হলে যেতে হয় লাতিন কোয়ার্টার মা সরস্বতীর সর্ব কলার চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, নৃত্য, আরও কত কী যে নিত্য নিত্য সৃষ্টি হয় ওইসব কলার পাগলা চেলাদের মাঝখানে, যারা তিন দিন ধরে একটা লোফ খায়।
কীর্তি এসব ডিটেল জানত না কারণ শিপ্রা ঘড়ি ঘড়ি তার প্যারিস ভিয়েনার জেল্লাই নিয়ে কথা কওয়া দূরে থাক, ইংরেজি সাহিত্যের কথা উঠলেও সার্ত বা মারলোকে টেনে এনে নিজের বক্তব্য জোরদার করবার চেষ্টা দিত না। কীর্তি শুধু জানত শিপ্রা প্যারিসে ছবি আঁকা আরম্ভ করে এবং এখনও চিলেকোঠায় ওই নিয়ে মাঝে মাঝে মশগুল হয়।
অতীতের ওইসব নানা পরিবর্তনের ফলে শিপ্রার চতুর্দিকে এমন একটি আবহাওয়া বিরাজ করত যে, ঘনিষ্ঠতার বাড়াবাড়ি না করেও সরল জন তাকে মনের কথা বলতে পারত। আর আমাদের শ্রীমান কীর্তিনাশকে নির্মাণকালে সৃষ্টিকর্তা যে প্যাচালো বুদ্ধির সংমিশ্রণ একদম করেননি সেটা ক্লাবের অগারাজ বেয়ারাটি পর্যন্ত জানত।
শ্যাম্পেনটাও পেটের ভিতর বুজু বুজু করছে।
কী করে যে হঠাৎ শিপ্রাকে শুধিয়ে বসল, সে-ই জানে না : আচ্ছা শিপ্রা, তুমি আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করো?… আই মিন, আই মিন আমাকে ভালোবাসো? তার পর আবার গবেটের মতো হুট করে বলে ফেলল, হাও সিলি!
গেলাসটা ছিল কানায় কানায় ভর্তি। চো করে এক হ্যাঁচকায় খতম করে খট করে সেটা টেবিলের উপর রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল।
কীর্তি ধরে নিয়েছিল, যে মেয়ে এতদিন ধরে কারও ফাঁদে ধরা দেয়নি– যদিও মাঝে-মধ্যে এর-ওর নামের সঙ্গে জড়িয়ে ওর বদনাম রটেছে আবার আপনার থেকেই সেটা কেটেও গিয়েছে সে বুঝি এহেন অবস্থায় স্মার্ট সমাজের সুপ্রচলিত পদ্ধতিতে খিলখিল করে হেসে উঠবে।
হল এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া।
ধীরে ধীরে আধ শোওয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে কীর্তিকে কাছে টেনে দুই বাহু দিয়ে আলিঙ্গনে বেঁধে খেল চুমো। তার পর তার গালে-মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। কীর্তি নির্বাক, অসাড়। এমনকি চুম্বন-আলিঙ্গনের সময় যে সাড়াটুকু দিতে হয় তার বিহ্বল অবস্থায় সেটুকুও সে দিতে পারেনি।
রুদ্র তপস্যার বনে বহুত্রাসে অত্যল্প আশে ভীরু অপ্সরা যেরকম প্রবেশ করে কীর্তির প্রশ্নটা বেরিয়ে এসেছিল সেইভাবে।
উত্তরে সপ্তর্ষিমণ্ডলের উজ্জ্বলতম তারকারাজি উভয় হস্তে সপ্ত গ্রহের আকাশকুসুম বর্ষণ করে আচ্ছাদিত করে দিলেন এই ধূলির অতি সামান্য প্রাণী কীর্তিকে।
.
০৫.
শিপ্রারই বাড়িতে পার্টি। তার এক বান্ধবী ফিরেছেন হাওয়াই থেকে হনিমুন যাপন করে। তাদেরই অনারে সুন্দুমাত্র পরিচিত জনকে নিয়ে মাঝারি গোছের শো। সবাই হেথাহোথা ঘোরাঘুরি করছেন গেলাস হাতে করে। বেয়ারাদের হাতের ট্রেতে আছে হুইস্কি, কন্যাক, ভোদকা আর বিয়ার। বর্দো বার্গেন্ডি রাইন মজেলের রেওয়াজ এদেশে নেই বললেই চলে। জোগাড় করাও কঠিন, বিগড়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়ি। কিন্তু শিপ্রার ওয়াইন-সেলার দার্জিলিঙের মোলায়েম আবহাওয়ায়। নিজেরও যেটুকু মোহ তা ওইসব কন্টিনেন্টাল দ্রব্যের প্রতি। সে-সবের জন্য ব্যবস্থা ড্রইংরুমের ভিতর। সেখানে যে দু পাঁচজন চিড়িয়া আসন নিয়েছেন তাদের প্রায় সবাই ফরাসি-জর্মন। তারা বিলক্ষণ অবগত আছে এই কলকাতা-সাহারায় শিপ্রাই একমাত্র ওয়েসিস্। সঠিক কোন টেম্পারেচারে এসব পানীয় ফুল্ল বিকশিত হয়ে এই ভিনদেশে স্ব-দেশের রস সুবাস বিতরণ করবে সে তত্ত্বটিতে শিপ্রা স্পেশালিস্ট।