আবার তার মন ভরে জেগে উঠল, আমি লোনলি। কেমন যেন মনের ভিতর হঠাৎ কে যেন একটা ইয়া লম্বা বিজয়-পতাকা খাড়া করে খটাস করে মিলিটারি কায়দায় তাকে একটা সেলুট ঠুকে জানাল সে বীর, সে বিজয়ী; শিপ্রা মহারানি ভিক্টোরিয়ার স্বয়ংবরে সে প্রিন্স্ এলবার্ট। কে না জানে ইয়োরোপের সর্বদেশের রাজপুত্ররা তখন জমায়েত হয়েছিলেন লন্ডনে যে যার রাজাড়ম্বর নিয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে কীর্তিনাশের বুকের ভিতর কে যেন বলে উঠল, ছিঃ! এ কী কথা! এটা কি আলিপুরের ঘোড়দৌড় যে তুমি পয়লা নম্বরি হয়েছ বলে দেমাকে মাটিতে পা পড়ছে না–ফারাক শুধু এইটুকু, ঘোড়ার চারটে পা, তোমার দুটো।
কে বোঝে এই সামান্য সত্যটুকু? ইহসংসারের সুদূরতম প্রান্তে একটি রমণী হোক। সে সুন্দরী সদাচার, হোক সে উপেক্ষিতা কদাকার– তার জীবন যেন হঠাৎ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে, মহাশূন্যে সে যেন হঠাৎ একা, সে লোনলি। সে তখন স্মরণ করল তোমাকে। তোমাকে স্মরণ করেছে– এর পর তো আর কোনও চরমতর সত্য নেই। এর থেকেই তো প্রতিষ্ঠিত হল যা জীবের কাছে চরমতম উপলব্ধি সে আছে, তার অস্তিত্ব তার নিজের কাছে এই প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
***
ওরে ইডিয়ট এদিকে আয়। কেটে পড়ছিস যে বড়!
হ্যাঁ, আধ ঘণ্টা পরে যেতে বলেছে। ততক্ষণে ঝপ করে আরেকটা
বার-এ তখন পুরোদমে যা তর্কাতর্কি চলেছে কোথায় লাগে তার কাছে উভয় ভিয়েতনামের লড়াই। যদিও তর্কের বিষয়বস্তু কবে সেই প্লাতো না লাওৎসের আমল থেকে।
ডানস– বেলি ডানস্– সেকস্।
সরকার পক্ষের প্রধান বক্তা কিউ সি শ্ৰীযুত সুদিনের মুখে এক বুলি। আর্ট ফর আর্টস সেক্। সঙ্গীত হোক, কাব্য হোক, নৃত্য হোক– তার একমাত্র উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি করা। বিদ্রোহী কবিতা জনপ্রিয় হওয়ার ফলে দেশের স্বাধীনতা আড়াই মিনিট আগে এল না পরে এল, মোনা লিজার ছবি দেখে তাবৎ ফরাসিনী পুত্রশোকে কাতর অবস্থায়ও আ লা মোনা লিজা মুচকি মুচকি হেসেছিলেন কি না, কিংবা বিলকুল শব্দার্থে কান-কাটা ভান গগের ছবি দেখে চিত্ৰামোদীগণ আপন আপন কান কাটাবার জন্য সার্জনদের কসাইখানায় কিউ কেটেছিলেন কি না সেটা সম্পূর্ণ অবান্তর। বেলি-ডান্স ইজ বেলি ডান্স্। আসল দ্রষ্টব্য, উদরমণি নাভিসরোবরে রূপসাগরের যে তুফান জেগে উঠল সেইটে দেখে তোমার চিত্তরাজ্য কি আকুল হয়ে ওঠেনি ওই সরোবরে অবগাহন করে হৃদয়জ্বালা জুড়োতে? তুমি কি ভুলে যাওনি ক্ষণতরে ক্ষুদ্র ওই নাভিকুণ্ড বিশাল চিল্কা কুণ্ড নয়, তুমি
কীর্তির মনে অন্য ভাবনা। শিপ্রার কাছে যাব কোন ড্রিংক খেয়ে? হুইস্কি মুইস্কি চলবে না। বে-এক্তেয়ার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। একদম সাদা চোখেও যাওয়া যায় না। পুরুষের যে তেজস্ বিচ্ছুরিত হয় তার ব্যক্তিত্ব থেকে, তার পৌরুষ সত্তা থেকে সেইটেই তো রমণীকে মুগ্ধ করে বিহ্বল করে, সেটাকে কোনও একটা ড্রিংক মারফত কিঞ্চিৎ মরাল সাপোর্ট তো দিতেই হয়। নাহ্- ওসব বিচার-বিবেচনা করা বেকার। কলকাতার কুল্লে নটবর, কড়ির কুবের, কালোবাজারের নম্বরি নম্বরি ঘড়েল যারা চালাকি আর মিষ্টি হাসির বঁড়শি দিয়ে চিফ ডিটেকটিভের নাড়িভুড়ি থেকে গোপন কথার এপেডিক্স টেনে বার করতে পারে তাদের সব্বাই হার মেনেছেন শিপ্রাদেবীর টেনিস-লনের ওয়াটারলুতে। তিনি মোহাতুর হন, তার সর্বাঙ্গে আবেশ লাগে, তাঁর বক্ষে অরণ্যমর্মর জেগে ওঠে- সবই। ওদিকে কিন্তু বিচার-বুদ্ধির মেকদার জ্ঞান অষ্টপ্রহর ঝাঝালো বাঙাল কাসুন্দির মতো। তাই তোমার মাথাটি রাখতে হবে ফ্রিজের আইস বসে। তার গড়া ট্রাফিক আইনের রেড লাইটটাকে পিংক মনে করে মাত্রা ছাড়িয়েছ তো গেছ। পক্ষান্তরে তিনি যে ভাগ্যবানকে গ্রিন লাইট দেখান তার ট্রাফিক রেগুলেশন সম্বন্ধে, কীর্তিনাশের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আজকের এই ভর রাতের ফোনে যেন কাঁচা সবুজের আবছা আবছা আভাস দেখতে পেল। সুতরাং বহু আত্মচিন্তা ততোধিক পরকীয়া কিংবদন্তি সুবিবেচনা করে কীর্তি স্থিরনিশ্চয় হলেন এহেন পরিস্থিতিতে ড্রিংকরূপে ক্রেম দ্য মৎ-ই প্রশস্ততম এবং তদনুযায়ী ড্রিংক শেলফের দ্বিতীয় স্তরের পূর্বতম প্রান্তে ক্ষণতরে কটাক্ষ হানল। বেয়াত্রিচের বরদাপাণি সেদিকে প্রসারিত হল।
ড্রিংক সমস্যা সমাধান করার পর কীর্তির কান গেল বেলি-ডানস্ তর্কাতর্কির দিকে।
সুদিন-বৈরী শঙ্কর বলছে রেখে দাও আর্ট ফর আর্টস সেক। নাইট ক্লাব, কাবারে ললিতকলা অ্যাকাডেমি নাকি যে এখানে সেই কাইরো না মরক্কো থেকে আসবেন খাপসুরৎ খাপসুরৎ উপকিরা পপ্যার আর্ট আর এপলাইড আর্ট বাবদে আমাদের তালিম দিতে? উইদ ডেমোনস্ট্রেশন। সেইটেই হল আসল তত্ত্ব। আর আর্টের কথাই যদি উঠল তবে বলি, প্রকৃত আর্ট আদ্যন্ত সবকিছু প্রকাশ করে না– ইঙ্গিত দেয় বহু না-বলা, অ-চাখা রসের প্রতি। আজকের নাচে নাভিকুণ্ডলী থেকে নৃত্যরস বহির্গত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে শিহরণ কম্পন জাগিয়ে তুলল এবং নিম্নগামী হয়ে যে রূপে প্রকাশ দিল তার ইঙ্গিতটা ছিল কোনদিকে? সেটা অশ্লীল।
এক ঠোঁটকাটা সদ্য বিলেতফের্তা হাবা সেজে শুধাল, ইঙ্গিতটা কোন দিকে ছিল সেটা আগিয়ে বুঝিয়ে বলুন, তবে তো করা যাবে শ্লীল-অশ্লীলের বিবেচনা।
আখ! তুমি কী সেখানে ছিলে না? যৌনসঙ্গম।