নাভিকুণ্ডলী নিয়ে এ হেন ভেল্কিবাজি দেখানো যে সুকঠিন, সুকঠিন কেন, অসম্ভব সে তত্ত্ব যে কোনও মাল-ডান্সার কসম খেয়ে স্বীকার করে নেবে। কিন্তু এহ বাহ্য, আগে গিয়ে পূর্ণ সত্য অনুভব হয় তখন, যখন রাত-কানা জনও হঠাৎ লক্ষ করে যে নটরানির বাদবাকি সর্বাঙ্গ নিশ্চল, নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ। বস্তৃত ওই যে ওটা গতিশীলা নিঝরিণী নয়, নিতান্তই সীমাবদ্ধ নিস্তরঙ্গ নিষ্প্রাণ সরোবর, অর্থাৎ দয়ের পাকচক্রে না থাকলে মনে কোনও দ্বিধারই উদয় হত না–এ তো মেয়ে মেয়ে নয়, প্রতিমা নিশ্চয়।
কীর্তিনাশ ফিসফিসিয়ে বলল, ঃ। এ তো স্রেফ হুনুরির একটা কৌশল! এতে আর্ট কোথায় জানেন শুধু কুবের কুল মেড়ো গুষ্টি। পেরেকের বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে কাটান যারা বর্ষা-বসন্ত তেনারা তা হলে এ মহাপ্রাসাদের বিজয়িনী মিশরিনীর চেয়ে হাজার দফে গুনিন পাভলোভা-শঙ্করের শুরুর গুরু। হবেও-বা। নইলে এ মহফিলের চাই সব মেডোরা এখানকার নাভিকুণ্ডে স্নান সেরে নাক বরাবর ধাওয়া করবেন কেন পেরেক শয্যাশায়ী শুরু মহারাজকে ঢিপ ঢিপ করে পেন্নাম জানাতে? ধন্যি, বাবা, তোমাদের আর্ট, নৃত্যকলা উর্বশীমার্গে মোক্ষলাভের চতুর্থ মার্গ!
ইয়ার সুদিনদা ঢের ঢের উঁচুদরের খলিফে। কীর্তিনাশের পাঁজরে কনুই দিয়ে একখানা সরেস গুত্তা মেরে বললেন, ওরে আচাভুয়ো চাটচিস হুইস্কির বোতলটা, আর শুধোচ্ছিস এতে আবার নেশা কোথায়? সবুর কর এক লহমা। এখখুনি তেড়ে আসবে উড়ের হাত থেকে হোজের জলের তোড়ের মতো রসের মুগুর। কালবোশেখীর ঝড়ের আগে, বটগাছের মগডালে অ্যাটুনটুন কাঁপন। উপস্থিত শুরু হয়েছে তারই যেন দোহার। দাঁড়া না, হুড়মুড়িয়ে ঝড় নামল বলে।
একদম করেকট আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বেতারকে ঢিঢ দিয়ে।
তবে হ্যাঁ, আলবৎ, ঝড়টা হুড়মুড়িয়ে নামেনি। নামল ধীরে মন্থরে। কিন্তু দিগবলয় আচ্ছাদন করে।
পুকুরের মাঝখানে ঢিল ছুড়লে যেমন সেখান থেকে চক্রটি চতুর্দিকে চক্রাকারে ক্রমে ক্রমে সম্প্রসারিত হতে থাকে এ ক্ষেত্রেও হুবহু তাই। নাভিকুণ্ডলীর নৃত্য ডাইনে-বাঁয়ে সম্পূর্ণ নীবিবন্ধকে উদ্বেলিত করে তুলল। এদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যে-রসকে বাজুবন্ধ খুল খুল যাওত রূপে সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে এস্থলে সে-রসই বাজুচক্র ত্যাগ করে কটিচক্রে সঞ্চারিত হল। নাভিচক্র থেকে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত হয়ে কম্পন আন্দোলন হল ঊর্ধ্বমুখী অধোগামী। সর্বদেহে কী আবেগ, কী আবেশ। হৃৎপিণ্ড মুহ্যমান।
পঞ্চেন্দ্রিয়, সর্বচৈতন্যের বিলুপ্তি আসন্ন।
বেয়ারা কীর্তিনাশের কানে কানে বলল, হুজুর, আপকে লিয়ে বহুত জরুরি ফোন।
.
০২.
হ্যালো?
হ্যালো। কীর্তি? শোনো–
এ যে একেবারে নয়া ব্যাপার। কীর্তির হৃদয়দুয়ারে লিলি ডলি বুজু নরগিস মাঝে মাঝে টোকা দিয়েছে বটে কিন্তু সে নিতান্ত হলে হল, না হলে না গোছ কিংবা অগত্যা ইংরেজিতে যাকে বলে অন্য এ রেনি ডে; আর এ হল ঠিক তার উল্টো, এখানে রে নামল খা খা খটখটে শুকনো মাঠে।
তুমি আধঘন্টাটাক পরে এখানে আসতে পার?
কেন? ব্যাপার কী?
মানে? তুমি কি কিছুই বুঝতে পারো না? তোমার কি কখনও বয়স হবে না? কেন, কেন, কেন? মিস্ত্রিকে বুঝিয়ে বলতে হয় কেন তাকে ডাকছি, দর্জিকে ডাকার কারণটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হয়! তুমি কোনটা যে তোমাকে কারণ দেখাতে হবে?
বেচারা কীর্তিনাশ। এই অবেলায় অকস্মাৎ অযাচিত অনুগ্রহ। এখন কি আর তার সে বোধশক্তি আছে যে কোনটা ঘটে সকারণে আর কোনটা ঘটে দেবতাদের যখন নিতান্তই কোনও কিছু করবার থাকে না বলে মানলি রিটার্নে নাম্বার অব অ্যাশ টেকেন দেখাবার তরে। শিপ্রা তখন দেবতাদের একজন। মূর্খ কীর্তির বোঝা উচিত ছিল, অকারণ অনুগ্রহই অনুগ্রহ।
হঠাৎ অতিশয় মধুরা নিস্তেজ গলায় কীর্তি, আমার বড় লোনলি লাগছে যে। তুমি এস।
খুট!
কে বলে কীর্তির নাম কীর্তিনাশ! কীর্তিমান পুরুষ সে। কীর্তিনাশা নদী যখন ওই বংশের সর্বশেষ সন্তানের সর্বশেষ পুকুরটি(!) পর্যন্ত গ্রাস করে ঢেউয়ের ডাকে ডাকে ঢেকুর তুলছেন তখন জন্ম নেয় এই সন্তান। বংশটা লোপ পেলেই করালী কীর্তিনাশা নদী আপন কৃতিত্বের পরিপূর্ণ সাফল্যলাভের আত্মপ্রসাদ প্রসাদাৎ অবশ্যই একটা কীর্তিস্তম্ভ নির্মাণ করতেন যে ভূমি গ্রাস করেছেন তারই কোনও এক ভেসে-ওঠা অংশের বালুচরে। সেটা যখন নিতান্তই হল না তখন শেষ সন্তান কীর্তিনাশ নামের স্কন্ধে পীঠ স্থাপনা করে একাই চৌষট্টি-যোগিনী রূপে উচাটন নৃত্য নেচে যেতে লাগলেন।
ফোন ছেড়ে ভরাপাল তুলে বার-এ ফেরার সময় কীর্তিনাশ আপন পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে মনে মনে বলল, ছোঃ, আমার নাম কীর্তিনাশ না কচুনাশ। শিপ্রাপুলিনবিহারী নাগরদের এক ফুঁ মেরে পাঠিয়ে দিলুম পদ্মর হে-পারে। সুদিনদাটা একদম বুড়ব। বলে কি না, ঘুড়িবুড়ির দোআঁশলা না কী যেন। যে রমণীর চতুর্দিকে অষ্টপ্রহর কবি সাহিত্যিক ফিলিমস্টাররা ঘুর ঘুর করছে, যার জিরোবার তরে একলহমা ফুরসত নেই সে মেয়ে ফিল করছে লোনলি। তার হৃদয়টা অত সহজে ভরে না। সুদিনের কথার কোনও মানে হয় না।
বার বার কীর্তিনাশের বুকের রক্তে রিনিরিনি করে বেজে উঠছে আমি লোনলি এবং সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বচৈতন্যে ছড়িয়ে পড়ছে গভীর এক প্রশান্তি।