তার চেয়ে ওখানে বসে যদি আমি হীরা-পানা বসানো সোনার চিরুনি দিয়ে কহকিনী মায়াবিনীর মতো চুল আঁচড়াই তবু না হয় ভেঁপো ছোঁড়ারা ওদিকে তাকিয়ে দু একটা রসাল টিপ্পনী কাটবে!
কীর্তির রোমানসে এই পয়লা খোঁচা। এবারে আসছে কু দ্য গ্রাস, ক্লের মোক্ষম মুষ্ট্যাঘাতে রোমান্স-বেলুনের শেষ সর্বনাশ।
অতি গুরুগম্ভীর হাস্যহীন আস্যে শিপ্রা বললে, সবচেয়ে খাসা মানায়, যদি আমি সেখানে কোমরে আঁচল বেঁধে টাটা স্টিলের কড়াইয়ের খাগড়াই কসার খুন্তি দিয়ে তোমার জন্য পুঁইশাকের চচ্চড়ি ঘাটাই।
আহা, যেন একটি সার্থক গবিতা! একটি বাক্যকেই তিন অসমান হিস্যেয় ভাগ করে তিন লাইনে ছাপলেই কোথায় পাউন্ড, কোথায় বন্ধু সমর সেন?
ডাস্টবি-এ পচা ইঁদুর
রিকশায় চীনা গণিকা
এগুলো মহাকাব্যরূপে স্বীকৃত হয়েছে। এবারে জুড়ে দিলে ময়দানের মিনারশিখরে ইশটিলের কড়াই।
কীর্তি যে ক্ষুণ্ণ হয়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল। হার মানতে মানতে তবু শেষ বাণ ছাড়ল–
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।
অতি সোহাগভরে দু হাত দিয়ে কীর্তির মাথা বুকে খুঁজে নিয়ে তার মধুরতম কণ্ঠে বললে– সে কণ্ঠস্বর তার পিতা বড় ভালোবাসতেন– ওরে ক্ষ্যাপা, প্রিয়াকে দেবতা করার জন্য প্রেমিক প্রেমিকা, উভয়েরই শাস্রাধিকার অর্থাৎ প্রেমাধিকার চাই। তোমার কিছুটা আছে বিধিদত্ত- কিন্তু দিনে দিনে সেটা বাড়বে না কমবে সেটাও জানেন একমাত্র বিধিই।
তুমি বার বার বলেছ, তুমি অপদার্থ, তাই তোমার ভিতর আমি কী দেখলুম যে তোমাকে ভালোবাসলুম? উত্তর দিই নি। আজ বলি, ওই প্রেমাধিকার। যাকে আমি নাম দিই ধাতু।
কীর্তি শুধাল, ধাতু? বুঝিয়ে বল।
শিপ্রা বললে, তোমাকে নির্মাণ করার সময় বিধাতা একটা বিশেষ ধাতুও মিশিয়ে ছিলেন। সেটা আমি চিনতে পেরেছি। এর বেশি বুঝিয়ে বলা যায় না। ওটা বোঝার জিনিস নয়, উপলব্ধির ধাতু। হয়তো নিজেই একদিন উপলব্ধি করতে পারবে। ব্যস! এখন চুপ করো।
.
১৪.
কীর্তিদের ক্লাব-বারের উচ্চ উচ্চ দণ্ডাসনে বসে ডাইনে-বাঁয়ে স্টিয়ার করাটা যারা সব সময় পছন্দ করতেন না, তারা আসন নিতেন ছোট ছোট টেবিলের চতুর্দিকে। আবদার ড্রিংক এনে দিত টেবিলে টেবিলে। আবদার কথাটা ফারসি থেকে এসেছে প্রাচীনতর যুগে, জোর চালু হয় কোম্পানির আমলে এবং ইদানীং মুমূর্ষ। যদিও আব শব্দের অর্থ জল, প্লেন ওয়াটার– যেমন আবহাওয়া ও দার কথাটার অর্থ, যে ধরে, যেমন জিম্মেদার তথাপি রূঢ়ার্থে সে মদ্যাদি তরল দ্রব্যের রক্ষক ও পরিবেশক। ইরান দেশে এই ব্যক্তিই যদি দ্ৰশ্রেণির শিক্ষিত তরুণ বা তরুণী হয় এবং বন্ধু বা বান্ধবীরূপে কাব্যালোচনা, সঙ্গীতাদির দ্বারা বিশেষ একজনকে আপ্যায়িত করে বা আসর জমিয়ে তোলে তবে তার নাম সাকি।
দণ্ডাসীনদের ভিতর কথাবার্তা হয় ছেঁড়া-ছেঁড়া। টেবিলওলাদের ভিতর মাঝে-মিশেলে দু একটি বিষয় নিয়ে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী আলোচনাও হয় কিন্তু আমাদের রক বা পাড়ার চায়ের দোকানে সেখানে প্রাগুক্ত ক্লাবের মতো একে অন্যকে চেনে এবং প্রায় সব খদ্দেরই বেনামি একটা ক্লাবের অনারারি মেম্বার যে রকম তর্কাতর্কির সাইক্লোন টর্নেডো বয়ে যায়, এই খানদানি ক্লাবে সেরকম হয় না। কারণ কেউই কোনও বিষয়ে সিরিয়াসলি নেয় না, কারওরই বিশেষ কোনও মতবাদে দৃঢ়বিশ্বাস নেই। তারা শুধু একটি বিষয়ে অচঞ্চল দৃঢ়মত পোষণ করেন পানের দ্রব্যটি যেন যে লোক যা নিত্যি নিত্যি খায় আজও যেন নির্ভেজাল তাই হয়। এবং যেহেতু সাধারণ মানুষ যদি কোনও বিশেষ একটা জিনিসের প্রতি তার সর্ব চৈতন্য সর্ব ধ্যানে পরিপূর্ণ নিয়োগ করে দেয় তবে সে অন্য সব বাবদে অম্লাধিক উদাসীন হতে বাধ্য– অর্জুন যে রকম পাখির চোখের দিকে তাগ করার সময় শুরু, ভ্রাতা এমনকি বৃক্ষটাকেও দেখতে পাননি। বাইবেলও বলেছেন, দুই প্রভুর সেবা করা যায় না!
আজ কিন্তু তর্কটা জমে উঠেছে। ইয়েহিয়া খান এসেছেন ঢাকায়। শেখ মুজিবের সঙ্গে একটা আপস করতে। কীর্তি এসে দলে ভিড়ল আলোচনা যখন অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে– বসল তার সুদিনদা ও ইয়ার খানের পাশে। যে সমস্যা নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে সেটা : ইয়েহিয়া কি সত্যই আওয়ামী লীগের হাতে পুব বাঙলার চোদ্দ আনা কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।
মিত্তির যদিও প্রায় প্রতি রাত্রেই কিঞ্চিৎ বে-এক্তেয়ার হয়ে বাড়ি ফেরে তবু সবাই জানে যে বদ্ধ মাতাল অবস্থায়ও সে যদি কাউকে কোনও কথা দেয় তবে পরের দিন সে কথা তুললে, যদিও সে সে কড়ার বিলকুল স্মরণে না আনতে পারে তবু ক্ষয়ক্ষতির পরোয়া না করে সত্য রক্ষা করবে। অতএব তার দৃষ্টিবিন্দু এক্ষেত্রেও সেই ঐতিহ্যগত। বলল,
তোমরা ভুলে যাচ্ছ ইয়েহিয়া সেপাই, অফিসার। সে পলিটিশিয়ান নয় যে ঘড়ি ঘড়ি ভোল পালটাবে। ইংরেজ জাতটা পলিটিকস করে। আমাদের হোমরুল, অটোনমি, হাফ-স্বরাজ, স্বরাজ দেবার হোলি প্রতিজ্ঞা করে সেটা ভঙ্গ করেছে। কতবার হিসাব নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক একই সময়ে গোপনে আরবদের কাছে কসম খেল যুদ্ধ শেষে প্যালেস্টাইন ওদের হাতে সঁপে দেবে এবং সঙ্গে সঙ্গে টাকার কুমির মার্কিনদের হুবহু ওই একই প্রতিজ্ঞা করল। যুদ্ধ শেষে চেষ্টা করল, নিজেই সেটা হজম করার। শেষটায় যখন নিতান্তই বদহজমে যায় যায়, তখন আরব আর ইহুদিদের লড়িয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। এবং দুই পক্ষকেই আগুনের দরে আউট অব ডেট পুর্না পুর্না বন্দুক কামান বিক্রি করল। ওদিকে দেখ দ্য গল। সেপাই। রাজ্য চালনার সময় আপন প্রতিজ্ঞা রক্ষার আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে পদে পদে মার খেয়েছে। ইয়েহিয়াও সেপাই।