তার পর আরামসে চোখ বন্ধ করে বললে, ভাগ্যিস, মা কালীর আশীর্বাদে তুমি-আমি কেউই যিশুখ্রিস্ট নই।
এমন সময় কোনও নোটিশ না দিয়ে কীর্তি হঠাৎ মাথা নিচু করে শিপ্রার একটা পায়ে চট করে চুমো খেয়ে অন্য পায়ে মুখ চেপে দিতে লাগল দীর্ঘতর চুম্বন।
ধড়মড়িয়ে শিপ্রা উঠে বসে কীর্তির মাথা চেপে ধরে বললে, ছি ছি! এ তুমি করছ কী?
কীর্তি কোনও উত্তর দিল না। নিরাশ হয়ে শিপ্রা বসে রইল।
অনেকক্ষণ পরে কীর্তির চুল ধরে তার মাথা টেনে তুলল তখন বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ ভাব না দেখিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললে, কেন? পদচুম্বন সমাসটা কি তোমার একেবারে অজানা। মানুষ গুরুর পদচুম্বন করে। কিন্তু আমি তো কখনও কোনও গুরুর কাছে দীক্ষা নেবার মতো পাত্র নই। তুমিই তো আমার গুরু।
বিস্মিত হয়ে শিপ্রা শুধাল, সে কী?
শোনননি চণ্ডীদাস তাঁর রজকিনীকে গুরু আখ্যা দিয়েছেন তাঁর গীতে?
সে তো তিনি তাঁর সাধনার ক্ষেত্রে রামীকে অনেক রূপেই দেখেছেন, অনেক নামেই ডেকেছেন। তুমি তো অপদার্থ অবশ্য তোমার আত্মাপলব্ধির ভাষায়।
অবাক করলে, গুরু, অপদার্থের তো গুরুর প্রয়োজন সর্বাধিক। খাঁটি সোনাতে কেউ কখনও পরশপাথর ছোঁয়ায় নাকি। আচ্ছা, তর্কস্থানে না হয় গুরুর প্রসঙ্গ বাদই দিলুম। কিন্তু প্রিয়ার পদচুম্বন কি তার প্রসাদলব্ধ জন করে না। তুমি যাকে গুরুদেব বলে প্রায়ই উল্লেখ করে তিনি গেয়েছেন :
অমল কোমল চরণকমলে চুমিনু বেদনাভরে—
শিপ্রা বাধা দিয়ে বললে, সে তো তাঁর জীবনদেবতার পদচুম্বন করেছেন তিনি।
রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে কীর্তি বললে, বা রে। এর কয়েক লাইন আগেই তো ওর সঙ্গে তার মহা সাড়ম্বরে, আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক চক্র ততোধিক রেখার জাল এঁকে শুভলগ্ন স্থির করে, শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে পুরোহিত বৃদ্ধ বিপ্রের হাতে ধান্য দূর্বা তীর্থবারি এবং মন্ত্রসহ বিয়ে হল এবং সখীদল ও শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের পর সামাজিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করল।
দোঁহাকার সাথে ফুলদল-সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।
এবং এই যে একটা অভূতপূর্ব, ইতিহাসের সর্ব স্বয়ংবর বিবাহকে আপাদ-মস্তক লজ্জিত বিড়ম্বিত করি পাণিগ্রহণ– আমি এই পাণিগ্রহণ সমাসটির দিকে তোমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, শিপি– এই পাণিগ্রহণ মহোৎসবটি সমাধান হল এটির নির্যাস, এটির মধুরতম মধুমন্ত্র পাচ্ছি :
অজানিত বধূ নীরবে সঁপিল শিহরিয়া কলেবর
হিমের মতন মোর করে তার তপ্ত কোমল কর।
বধূ, বধূ, বধূ আবার বলি বঁধু নয়, বধূ।
সেই বধূর পদচুম্বন করেছিলেন আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ যার ভিতর সকল রসের ধারা সর্বদেশ সর্বকাল থেকে বয়ে এসে সম্মিলিত হয়েছিল। দম নিয়ে কীর্তি বলল,
তোমরা যা বল তাই বল, আমার কাছে বধূ যা জীবনদেবতাও তা।
এর পর দেখ, কবিতাটি তোমার আমার অতি কাছে চলে এল। কবিতার সখী পথ দেখিয়ে বরবধূকে বাসরঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখানে স্বয়ং তুমি। তার পর পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি শয়নে বসিলা বধূ তুমি যদি সে-ভাবে চরণ প্রসারিত করতে তবে আমি ছুটে গিয়ে পাদপীঠ সগ্রহ করে আনতুম না। তুমি যে শয়নে চরণ প্রসারিত করলে। তাই তো আমাকে ওই অবস্থাতেই পদচুম্বন করতে হল।
ইতোমধ্যে শিপ্রা তার দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে কীর্তির কবিতা আবৃত্তি, তার আপন টীকা কিছুটা শুনছিল। কিছুটা আপন মনে ভাবছিল। তার রাশি রাশি চুল চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কীর্তি মাত্র দু দিন ধরে দরদি হিয়ার আহ্বান পেয়ে বক্ বক্ করতে শুরু করেছে। কিন্তু অতদিনের নীরব স্বভাব চট করে যায় না বলে চুপ করে শিপ্রার চুলের ভিতর এদিক-ওদিক আঙুল চালাচ্ছে।
হঠাৎ শিপ্রা মাথা তুলে কীর্তির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে স্পষ্ট স্বরে বলল, এসব প্রাণের কথা কার না শুনতে ভালো লাগে? কিন্তু, কীর্তি, আমার মন বার বার ঘুরেফিরে ওই পাদপীঠ কথাটির দিকে যাচ্ছে। পাদপীঠ, সোজা বাঙলায় চৌকি, ইংরিজিতে পেডেস্টেল। তোমার হৃদয়ে দু দিনেই আমার যা মূর্তি গড়ে তুলছ তার পাদপীঠটা উঁচু হতে হতে এখন সেটা ময়দানের বিরাট বিরাট মূর্তির দশ হাত উঁচু পাদপীঠ, স্ট্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, না তুমি আরম্ভ করেছ পাদপীঠ দিয়ে। সেটাকে গড়েছ তোমার চেয়ে তিন মাথা উঁচু। তার উপর খাড়া করবে বা বসাবে নিশ্চয়ই কোনও দেবীপ্রতিমা– অন্য কিছু মানাবে কেন? এবং স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছি সে দেবী আমি। নয় কি?
কীর্তি মুগ্ধ হয়ে ভাবছিল, আহা, এই তো শিপ্রা। রবি-কাব্যের কত না অতলে ডুবেছে সে। অথচ প্রয়োজনমতো আমার মতো এমেচারের সঙ্গেও সে কদম কদম মিলিয়ে চলতে পারে। ওই তো তার মহৎ গুণ। পার্টিতে, ব্যবসাতে, বিয়েবাড়িতে সর্বত্র সে ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সক্কলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে।
শিপ্রার প্রশ্নের উত্তরে কীর্তি, যেন সমের শেষে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, অবান্তর, অবান্তর এ প্রশ্নটা। প্রশ্নটাই স্বতঃসিদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ!
হায় রে কীর্তিঠাকুর! তুমি এখনও তোমার শিপ্রা চতুরাকে চিনতে পারনি। সে যেন সন্দেহের ধন্দে দোটানা হয়ে বলল, তোমার ওই কবিতাতেই আছে, বিয়ে বাড়িতে ছিল।
সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ!
বাঙ্গালোরি শাড়ি, বেনারসি ব্লাউজ আর ছেরামপুরি খোঁপা– ওই তো আমার সাজ। এ কি মানাবে সিংগির ঘাড়ের উপর বসলে?