তোকে যে ম্যাডাম শিপ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলুম সেটা মহালগন। শিপ্রাপারে পৌঁছে গেছিস, আর তোর মাথাব্যথা কিসের। শিপ্রা তো মধ্যপ্রদেশে? না? ঝেড়ে দে না একখানা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম ওই প্রভিনসের টুরিস্ট ব্যুরোকে। ব্যস। তবে হ্যাঁ, ওদের ব্লেজার ট্রিপ লাঞ্চে আকছারই যাত্রী থাকে দেদার।
তা সে যাক্ গে। কথা হচ্ছিল,
আখ-খ-খ। শাস্ত্রালোচনায় অহরহ বিঘ্নবিপত্তি!
কী ব্যাপার?
বার-টার পাশেই ডাইনিং-ডানসিং-কাবারে এই তিন প্রকারের আনন্দভবন মিলিয়ে ঢাউস এক জলসা-দরবার। বার-এ তো মেয়েমদ্দে গিসগিস করছিল, সে তো প্রায় উদয়াস্ত লেগেই আছে। কিন্তু নবাব খাঞ্জা খাঁর আসল রঙ-মহল পাশের সেই পঞ্চরঙ্গের শ্রীরঙ্গমে একবার কেউ সম্মুখসগ্রাম লড়ে সে ভিড়ে প্রবেশ করতে পারলে সে ব্যক্তি আর কস্মিনকালেও বলবে না, কলকাতার বাসগুলো বড় ক্রাউডেড। আপনি শক্তসমর্থ জোয়ান মদ্দ মানুষ–আপনার নিতম্ব নিমর্দিত হবে মুহুর্মুহু। আপনি ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন মানেন– আপন রিজার্ভড় টেবিলে পৌঁছতে না পৌঁছতে আপনি দলিত মর্দিত পিষ্টিত এবং আলিঙ্গিত হবেন কেরালার তন্বী শ্যামা থেকে আরম্ভ করে, নর্ডিক ব্লন্ডিনীগণের অকৃপণ সহযোগিতা পেরিয়ে সর্বশেষে পুঞ্জীভূত মাংসাধিকারিণী মার্কিনিদের সঙ্গে অগুনতি কলিশন লাগিয়ে লাগিয়ে নব নব রেকর্ড নির্মাণ করে করে।
সেখানে লেগেছে আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়া এক ধুন্ধুমার।
আমাদের দুই ইয়ার এসব ব্যাপারে সচরাচর নির্বিকার। বলতে গেলে এরা এবং এদের গণ্ডা দুই দোস্ত মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে হাঁটতে শিখেছেন এই জলসাঘরেরই মার্বেল পাথরের মেঝের উপরে।
কিন্তু আজ ভিন্ন গীত।
কাইরো না বেইরুৎ কোথা থেকে এসেছেন সদলবল এক বিশ্ববিজয়িনী নর্তকী। উর্বশী মেনকা থেকে আরম্ভ করে ইজাডরা ডানকান্ আনা পাভলোভা তক আবহমান কাল থেকে আর সবাই নেচেছেন দু খানা পা দিয়ে, কিন্তু এই দিগ্বিজয়িনী নাচবেন পেট দিয়ে। সোনার পাথরবাটিও বুঝি কিন্তু, কিন্তু পেট দিয়ে নাচ!
সাপ হাঁটে পেটের উপর দিয়ে কিন্তু সে-ও তো দেখি নাচের সময় পেটের তোয়াক্কা না করে নাচে কাঁধ দিয়ে, ফণা দিয়ে, কোমর দিয়ে, ল্যাজ দিয়ে, যদিও সাপের পেটটা তার দেহের আগাপাশতলা জুড়ে। আর যদি ভাবার্থে নেন তবে এই সেই উদরসব ফিরিঙ্গি জাত, সে-ও তো পাক্কা দু শোটি বচ্ছর এদেশের চাষাভূষোর অন্ন মেরে আপন পেট ফাটিয়ে দিল, কিন্তু কই, তাকেও তো কখনও ওই দুনিয়া-খেকো পেট দিয়ে নৃত্যের তালে তালে মা মহারানির বন্দনা করতে দেখিনি।
যে কলকাতার তাবল্লোক পাঁচপেয়ে বাছুর দেখার তরে রিস্টওয়াচ গচ্ছা দিয়ে রেস্ত জোগাড় করে তারা আসবে না হদ্দমুদ্দ হয়ে এই বেলি-ডান্স, ঔদরিক নৃত্য পেটভরে দেখতে।
দুই ইয়ার ওই উত্তাল জনসমুদ্র উলুজ্জন অসমীচীন বিবেচনা করে জোগাড় করলেন একখানা উচ্চপদী চেয়ার। তার উপর দাঁড়াতেই স্পষ্ট দেখা গেল নাতিবিস্তীর্ণ নটমঞ্চ।
তখনও উচ্ছেভাজার পয়লাপদ শেষ হয়নি। অর্থাৎ নটরাজ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে নন্দীভৃঙ্গী দু কদম আনাড়ি নৃত্য নেচে নিচ্ছেন। তখন বোঝা গেল, হট্টগোলটা উঠেছিল বিরক্তি এবং কথঞ্চিৎ উন্মা বশতও বটে– এসব হাবিজাবির ঠেলায় মেঘে মেঘে যে বেলা হয়ে গেল, আসল মাল বের করবে কখন? এরা কি পিত্তি না চটিয়ে খেতে জানে না।
হঠাৎ সব আলো ক্ষণতরে নিভে গেল। পাঁচ নাগর তার ফায়দাটা ওঠাবার পূর্বেই নন্দনকানন থেকে নেমে এল এক শ্যাফট নীল আলো। আবছা আবছা দেখা গেল যেন সমুদ্র থেকে ভেসে উঠছেন মরুভূমির স্কি, কিন্তু, তন্বঙ্গী নারীরূপিণী এবং দেখা-না-দেখার আলোছায়ার ইন্দ্রপুরীর যেন ইন্দ্রধনু।
সে আবেশ কাটতে না কাটতেই আরও অকস্মাৎ কী হতে কী যেন হয়ে গেল। হলসুষ্ঠু তাবজ্জন যেন বানের জলে হাবুডুবু খেতে লাগল। নাহ! তেমন কিছু একটা প্রলয়ঙ্করী ব্যাপার নয়। মাত্র গণ্ডা দশেক সূর্য জলসাঘরের মধ্যিখানে যেন একটা এটম বমের মতো ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর তারই আচমকা ধাক্কায় তাবৎ পেট্রন-পেট্রনিদের চোখের মণি গেছে উল্টে–সেঁধিয়ে গেছে ভেতর বাগে।
স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে নটরানি– সেই বন্যার উপরে স্টেজের মাঝখানে।
সম্পূর্ণ নিশ্চল। চোখের পাতাটিতে পর্যন্ত কম্পন শিহরণ স্পন্দন কিছু না, কিচ্ছুটি নেই। কিন্তু ওই নিশ্চলতা থেকে সঙ্গে সঙ্গে যেন কোন এক চুম্বন সক্কলের দৃষ্টি টেনে নিয়ে গেল নটরানির নাভিকুণ্ডলীর দিকে।
টগর ফুলের পাপড়ি কোমর বেঁকিয়ে যেন সর্বাঙ্গে পাক খেয়ে ঢলে পড়ে পাশের পাপড়িটির উপর, তিনি ফের তার সখীর উপর এবং এই করে করে মাঝখানের স্থির বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে সবকটি সখী যেন নেচেই যাচ্ছেন, নেচেই যাচ্ছেন একে অন্যের পিছনে আমৃত্যু সে রাসনৃত্য!
নটরানির নাভিকুণ্ডলীটি যেন টগরিনীদের রানি।
ক্ষুদ্রাতিতম ক্ষুদ্র নটরানির নাভিটি; কেন্দ্রবিন্দুটি। আর সেই বিন্দুটিকে কেন্দ্র করে হুবহু টগরের পাপড়ির মতো মাংস বলুন, পেশি বলুন, একের পিছনে আরেকটি যেন নেচে চলেছে চক্রাকারে। নাভিকুণ্ডলীর দয়ে যেন ক্রমাগত পাকের পর পাক খেয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুগঠিত পেশি-পাপড়ি।
টগরের পাপড়ি নাচে এক জায়গায় ধীরস্থির দাঁড়িয়ে। এস্থলে তা নয়। এ নারীর কুণ্ডলী-পাপড়ি পরিপূর্ণ প্রাণবন্ত। এরা একে অন্যের পশ্চাতে কভু দ্রুত কভু মন্দ লয়ে যেন চটুল পদক্ষেপে পটীয়সী রাশান বা-এ নর্তকীর মতো নৃত্যে নৃত্যে চক্র রক্ষা করে।