কীর্তি বলল, ইংরেজের কি ট্যাঙ্ক-প্লেন ছিল না। তত্ত্বকথার মূল তত্ত্ব কী জানিস? আজ যদি ক্লেসিয়াস ক্লে আলি তোকে রাস্তায় পেয়ে এক ঘুষিতেই লম্বা করে দেয় সেটাতে তো তোর লজ্জা পাবার কিছু নেই, কিন্তু তার পর যদি তুই তার দাসত্ব স্বীকার করে নিস, সেখানে লজ্জা। ট্যাঙ্ক-প্লেনের শক্তি দিয়ে কাল যদি পাঞ্জাবি টের পাল পুব বাঙলাকে ছারখার করে দেয় তাতে বাঙাল লজ্জা পাবে কেন? শক্তিশালী হামেশাই দুর্বলকে পরাজিত করে।
কিন্তু তার পর যদি বাঙা পাঞ্জাবির দাসত্ব স্বীকার করে নেয় তবে সেখানে বাঙালের লজ্জা। তুই-আমি বাঙালি আমাদেরও লজ্জা।
.
১৩.
শিপ্রা অভিমানের সুরে বললে, এত দেরি করে এলে? এরই মধ্যে আমাকে অবহেলা?
কীর্তি অবাক। সামলে নিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, রবিঠাকুর ছাড়া দেখছি আমাদের গতি নেই :
তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।
আমি এসেছি তোমার দেওয়া সময়ের দশ মিনিট আগে এবং অতি ভয়ে ভয়ে। কারণ তোমাকে ঘরসংসার দেখতে হয়, তার ওপর পুরো তদারকি করতে হয় ব্যবসা-সম্পত্তির। এবং সর্বোপরি কয়েকটা চ্যারিটির হিসাবপত্র দেখা। ইজ্যাক্ট টাইমের এক মিনিট পূর্বে এলে হয়তো বারান্দায় মোক্ষম এক ধাক্কা, কোন এক ঝুনঝুনিয়া বা টুনটুনিয়ার সঙ্গে। আর তিনি হন যদি সিস্টার তেরেসা বা ক্লারা তা হলে তো কেলেঙ্কারি ব্যাপার। যাকে বলে, আমি মরমে মরে যাব, তার শরমে শে শে।
শিপ্রা বললে, উপরে চল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললে, চ্যারিটির কাজ যৎসামান্য। আমি নিজে সেসব স্থলে যাই। সিস্টারদের পক্ষে এখানে আসা সহজ নয়। এবং শুনেছি ক্যাথলিক নাদের অন্তত দুজন না হলে রাস্তায় বেরুনো বারণ। সে কথা থাক। আসল কথাটা শোনো। মনে কর কেউ যদি স্থির করে তার সাংসারিক সব অভাব দূর না হওয়া পর্যন্ত কোনও ভিখিরিকে ভিক্ষে দেবে না, কেউ যদি ভাবে বৈষয়িক সব ব্যাপার গোছগাছ না করে বৃন্দাবন যাব না, তা হলে এঁরও আজীবন ভিক্ষে দেওয়া হবে না, ওঁরও কস্মিনকালে তীর্থদর্শন হবে না। প্রত্যেক দানকর্মে থাকে আত্মবিসর্জন, ক্ষতিস্বীকার তা সে যত সামান্যই হোক। এই যে তুমি ক্ষুদ্রতম এটিকেট রক্ষার্থে বন্ধুর সিগারেট আগে ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা পরে ধরাচ্ছ তাতেও আছে পাঁচ সেকেন্ডের সেকরিফাইস।
কীর্তি সোৎসাহে বললে, হা হা, মনে পড়ছে, তুর্গেনিয়েফও বলেছেন, রকফেলারের লক্ষ লক্ষ ডলার দানের কথা যখন মনে আসে তখন আমার হৃদয়ে তার প্রতিদানে কৃতজ্ঞতা, কিন্তু যেদিন দেখলুম, আমাদের গ্রামে আটটি কাচ্চা-বাচ্চার বাপ এক অতি গরিব চাষা একটি অনাথ বাচ্চাকে বাড়িতে এনে আশ্রয় দিল তখন তার স্মরণে আমার মাথা গভীর গভীরতম শ্রদ্ধায় নত হয়। চাষার ভয় ছিল তার বউ সংসার চালাবার জন্য প্রতিটি কোপেক গোনে, সে দারুণ চটে যাবে। সে রান্না করতে করতে শুধু আপন মনে মন্তব্য করেছিল, এখন থেকে আমরা সপ্তাহে যে একটা দিন পরবের রোববারে চিজ খেতুম সেটা ছাড়তে হবে। আমার ঠিক ঠিক মনে নেই
কিছু দরকার নেই এ ঘটনাটির বর্ণনা তুর্গেনিয়েফের ভাষায় দেবার। ছ বছরের বাচ্চাও যদি এটি আধো আধো কথায় প্রকাশ করে তবু তার মূল্য এক কানাকড়ি কমবে না। লক্ষ টাকা দামের ফুলদানিতে একটি গোলাপ রাখো, আর চার আনার কাঁচের গেলাসে রাখো, গোলাপের সৌন্দর্য কি তখন আসমান-জমিন ফারাক হয়ে যাবে?
কিন্তু তোমার উদাহরণ সত্যি ক্লাসিক পর্যায়ের। রকফেলার বিশ লক্ষ ডলার দান করে কী ক্ষতিটা স্বীকার করলেন? ব্যাঙ্কের খাতাতে কয়েকটি শূন্য কাটা পড়ল মাত্র। বস্তৃত তন্মুহুর্তেই তিনি পাইকিরিতে আরও বিশখানা রোলস্ কিনতে পারেন।
তার নিভৃত বুদওয়ারে কীর্তিকে নিয়ে গিয়ে শিপ্রা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল তার ডিভানের উপর। কীর্তিকে বললে, বসো আমার পায়ের কাছটায়– আমি কেষ্টঠাকুর না হলেও তুমি তো অৰ্জুন। তিনি বুদ্ধিমান; ঠাকুরের পায়ের কাছে আসন নিয়েছিলেন। নিছক বিনয়বশত নয়; তার কুটিল স্বার্থ ছিল। আমারও তাই। তোমার মুখ দেখতে পাব বলে।
বলতে বলতে তার খোঁপা খুলে চুলে বিলি দিতে দিতে মাথার পাশের গোটা তিনেক কুশন ঢেকে দিল। কীর্তি লম্বায়, পরিমাণে এরকম রাশি রাশি চুলের স্তূপ আগে দেখেনি। বিস্ময়ে সেটার প্রশংসা করতে ভুলে গিয়ে বলল, তোমার খোঁপা দেখে তো আমার কখনও মনে হয়নি তোমার এত চুল।
কোঁকড়া চুলের ওই একটিমাত্র সুবিধে। কিন্তু আমার বক্তব্য শেষ হয়নি।
নির্দিষ্ট সময়ের আধঘণ্টা পূর্বে কিংবা হঠাৎ বিন্-নোটিশে এলে তুমি। তোমাকে তখন বসিয়ে রেখে টাকাকড়ির টানা-হ্যাঁচড়া করব ওই টুনটুনিয়া না ঝুনঝুনিয়ার সঙ্গে ইভন ফাইভ মিনিটস? নো, এ হানড্রেড টাইম নো। তাকে তদ্দণ্ডেই বিদায় দিলে কী হবে। একটা ডিল হয়তো হবে না। ঝুনঝুনিয়াও বিরক্ত হবেন।
ওরে হাবা, শোন, এইটুকু যদি আমি ত্যাগ স্বীকার না করতে পারি তোর সঙ্গ পাবার তরে তবে তোর মূল্যটা কত? ডিলটাতে হয়তো আমার দশ হাজার টাকার মুনাফা হত। তা হলে যে কোনও মুদি তোকে বলতে পারবে তোর দাম নিশ্চয়ই দশ হাজার টাকার চেয়ে কম– এ তো সোজা হিসাব। আর স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের মূল্য কত? মাত্র ত্রিশটি মুদ্রা। অবশ্য তাঁর যে শিষ্য তাকে বেচে দিয়েছিল দুশমনদের কাছে সে ছিল গ্যালিলির জেলে। আজকের দিনেও সেখানে ত্রিশ মুদ্রা পর্বতপ্রমাণ। আর আমার কাছে দশ হাজার কী! ওদিকে দু হাজার বছর ধরে দুনিয়ার দ্র-ইতর সক্কলের কাছ থেকে জুডাস পাচ্ছে অভিসম্পাত। আমাকে দেবে ক-হাজার বছর ধরে ঝুনঝুনিয়ার কাছে তোমাকে বেচে দেওয়ার জন্য।