এর ফলে কী হবে জানিস? হিটলারি রাজের আখেরি ওক্তে যা হয়েছিল, ঠিক তাই। এরা হয়ে যাবে আপন প্রপাগান্ডার ভিকটিম! একদম টপ-এ যারা আছে– ইয়েহিয়াকে ঘিরে– তারা জানে এসব মিথ্যে প্রপাগান্ডা। কিন্তু যদি আখেরে বাঙলাদেশ রুখে দাঁড়ায় তবে সেটাকে দমন করার প্রস্তুতির ভার যে শত শত অফিসারের কাঁধে পড়ছে, তারা তো জানে না এসব ডাহা মিথ্যে, তারা ভাববে এসব বাড়াবাড়ি, মশা মারার জন্য খামোখা সেই কোন সুদূর পুব পাকিস্তানে পাঠাতে হবে কামান-ট্যাঙ্ক। কাজে আসবে গাফিলি। পানি-কাদা সাপ-জোঁকের দেশে এমনিতেই পশ্চিম পাকি সেপাই যেতে চায় না, এখন সেখানে যেতে হবে বিদ্রোহ দমন করতে? কিসের বিদ্রোহ? অ্যাদ্দিন ধরে তোমরা গাইলে ভিন্ন গীত। সাধারণ সেপাই যদি অফিসারকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে তবে আর্মির মরালটি হয়ে যায় ঝরঝরে।
আখেরে মামেলাটা এ শেপ নেবে কি না, সে জানেন আল্লা। কিন্তু লাহোর-পিন্ডির ক্লাবে ক্লাবে কী অন্ধ আত্মপ্রসাদ, কী কাণ্ডজ্ঞানহীন বড়-ফাট্টাই।
আর মদের কথা যদি তুলিস তো আমরা কলকত্তাইয়ারা ওদের তুলনায় শিশু, শিশু, শিশু। আমাদের সবচেয়ে বড় ক্লাবে সম্বৎসরে যে পরিমাণ খাওয়া হয় তাই দিয়ে ওদের ছোটাসে ছোটা ক্লাবের কপালে তিলকটি কাটা যাবে না। জালা জালা মদের সঙ্গে সঙ্গে সব্বাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালিগালাজে ভর্তি অশ্লীলতম ভাষায় যেসব নোংরা নর্দমায়। তারা গড়াগড়ি দেয়, গল্পের নামে মোস্ট পয়েন্টলেস যেসব মলকুণ্ডের বর্ণনা দেয় সে-সব না শুনলে কোনও দেশের গাটারস্নাইপও বিশ্বাস করবে না যে, নগরের সবচেয়ে সম্মানিত ক্লাবে দ্রসন্তানরা এসব বলে, শোনে আর চতুর্দিকে কী অট্টহাস্যের গমগমানি।
আমাকে এক্কেবারে চাটনি বানিয়েছিল সর্বশেষে এক জমিদার ব্যারন বললেই ঠিক হয় বাড়ির একটা বিরাট হলঘরে। ব্লু ফিল্ম কখনও দেখেছিস? তার বাস্তব– থাক্। তুই যে আমার ছেলেবেলার বন্ধু যার সামনে আমি হরহামেশা প্রাণ খুলে সব কথা বলেছি, তোকেও ভাই বলতে পারব না।
কীর্তি বললে, বলারই-বা কী দরকার?
খান বললে, না ভাই, শুধু বলার জন্যই বলছিনে। আমি শুধু ভাবি এইসব আত্মপ্রসাদমত্ত দিবান্ধ, মিথ্যা ভাষণ যাদের হাড়ে হাড়ে এমনই ঢুকে গেছে যে পবিত্র শপথগ্রহণের সময়ও কুণ্ঠা নেই, লজ্জা নেই, যৌন ব্যাপারে যারা পশুর চেয়েও অধম এরা ভাবে এরা সভ্য, এদের তুলনায় পুব বাঙলার লোক জংলি, বর্বর। এসব ব্রুটগুলো শাসন করতে চায় সরল, বিশ্বাসী, দ্র পুব বাঙলার লোককে!
খান ভালোভাবেই জানত, কীর্তির মতো মাত্রা রক্ষায় অভ্যস্ত বনেদি ঘরের ছেলের কাছে এসব অবিশ্বাস্য, এসব তার কল্পনার বাইরে, তার দৃষ্টিচক্রের বহু বহু দূরে। পাকেচক্রে যদি-বা সে এ জাতীয় পশ্বাচারের কাছে-পিঠে এসে পড়ে তবে সঙ্গে সঙ্গে তার ইনসটিনটই তার লাগাম ধরে উল্টো পথে ডার্বি স্পিডে তাকে ছুটিয়ে দেবে। কিন্তু সে নিজে এ যাত্রায়, বিশেষ করে ব্যারনের বাড়িতে যে পাইকিরি পাপাচার যে সামান্য অংশটুকু দেখেছিল, এবং পরে শুনেছে আর সব জমিদারবাড়িতেও এসব ডাল-ভাত, পুরুষানুক্রমে চলে আসছে তাই নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করছিল এক একটা জাত এ রকম পথে চলে কী কারণে? আর পাঁচটা জাতের সঙ্গে মেলামেশার পরও নিজেদের সভ্যতর মনে করে কোন যুক্তি দিয়ে? দুজনাই চুপ।
খানই শেষটায় বললে, তুই তো জানিস আমাকে পুরো দুটি বৎসর লন্ডনে কাটাতে হয়েছিল, বাবার হুকুমে। ইংরেজের সঙ্গে আমার যে খুব-একটা দহরম-মহরম হয়েছিল তা নয়। তবু তাদের চরিত্র, সামাজিক আচরণ খানিকটে আমার নজরে আসে। অবশ্য যেসব বিশেষ বিশেষ সীমাবদ্ধ সম্প্রদায় থেকে ইংরেজ ভারতবর্ষে রাজত্ব করার জন্য লোক সংগ্রহ করত তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বৃহৎ অভিজ্ঞতা আমি যেটা অনিচ্ছায় সঞ্চয় করেছি সেটা তাদের অজ্ঞতা, সর্বগ্রাসী অজ্ঞতা। শিক্ষিত অশিক্ষিত তা তারা খবরের কাগজ পড়ুক আর না-ই পড়ক– শতকরা ৯৯ জন বাইরের দুনিয়ার কোনও খবর তারা রাখে না। ফ্রান্সে, শুনেছি, অজ্ঞতাটা তারও বাড়া।
পাঞ্জাবি সেপাইয়ের জনপদবধূ কি জানে, পুব বাঙলা কোথায়? এবং সেখানকার বধূর বুকে তারই মতো একটা সুখ-দুঃখ, দু মুঠো অন্নের যেন অনটন না হয় তার তরে তারো জীবনভর একই দুশ্চিন্তা!
তুই শুনলে হাসবি, আমি লাহোর ক্লাবের মেম্বার, ইংরেজ ও গাঁইয়া মেয়ের অজ্ঞতার ভিতর বিশেষ কোনও তফাত দেখিনে। লাহোরের মেম্বার ভ্যাটভূট করে ইংরেজি বলতে পারে বলে আমরা ভুল ধারণা করে বসি তারা বুঝি আপ টু ডেট।
এই সর্বব্যাপী অজ্ঞতার মাঝখানে ইংরেজ শাসকের অজ্ঞতা তাকে দিয়েছিল ভারতীয়ের প্রতি অবজ্ঞা আর পাঞ্জাবি করে ঘৃণা পুব বাঙলার লোককে। তুই তো ঘটি, তবু নিশ্চয় জানিস ওরা বড় টাচি, বাঙলাকে অবহেলা করলে সে তার উত্তর দেয় তিন ডবল অবহেলা দিয়ে। ইংরেজের অবহেলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে তাই তার একটু সময় লেগেছিল। কিন্তু ব্যাটা যেদিন ঠিক ঠিক বুঝে যাবে, পাঞ্জাবি শুয়ারটা তাকে ঘৃণা করে, তখন শুরু হবে আতসবাজি।
খান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললে, সবই ঠিক, কিন্তু জানিস তো জোর যার মুলক তার। ব্যাটাদের শুধু বন্দুক নয়, আছে ট্যাঙ্ক-প্লেন।