শিপ্রা বললে, কথাটা অতি সত্য। আমার হাতেখড়ি হয়েছিল বাবার কাছে পাশে এক গুরুমশাই বসেছিলেন মাত্র। স্কুল না-যাওয়া অবধি তাঁরই কাছে সব শিখেছি : প্রাইভেট টুটার বাবা ককখনও রাখেননি। কলেজে পড়ার সময়ও বাবার ঘরের এক কোণে বসে অধিকাংশ সময় পড়াশুনো করতুম। মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন শুধোতুম। জানা থাকলে সুন্দর বুঝিয়ে দিতেন– আর কী অসীম ধৈর্য। না জানা থাকলে একগাল হেসে বলতেন, ওরে শিপি, তুই যে বাপ-মারা বিদ্যে রপ্ত করে নিচ্ছিস। তার পর তার কোনও এক বন্ধু বা পরিচিত স্কলারের কাছে পাঠিয়ে দেবার সময় বলতেন, শিখে এসে আমায় বাতলে দিস্। তাঁর আর একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গুরুকে আপন বাড়িতে টেনে আনলে সত্য বিদ্যার্জন হয় না। গুরুগৃহে বসে থাকবে বারান্দার বেঞ্চিতে– গুরুর কখন কৃপা হয়।
কীর্তি মুগ্ধ হয়ে বলল, শিপি, তুমি সত্যি ভাগ্যবতী।
শিপ্রা বললে, আমার নামে কীসব বদনাম রটে তার খবর আমি রাখিনে আমরা যারা পার্টি-ফার্টি করি তাদের মধ্যে কার না বদনাম হয়! কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও বিবাহিতা রমণী বলেনি আমার বাড়ি থেকে তার স্বামী বে-এক্তেয়ার হয়ে ফিরেছে। বাবা বলতেন, তুমি লেডি। এ আইনটা বিশেষভাবে তোমার বেলা প্রযোজ্য। আর আমি নিজে যে সবচেয়ে মোলায়েম ড্রিংকে সীমাবদ্ধ করে নিজেকে সংযত রাখব সে-বিষয়ে তার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না।
কীর্তি হাবা ছেলের মতো গদগদ সুরে বলল, সে কি আমরা জানিনে? কিন্তু ড্রিংক। কেন, কোন ব্যাপারে তোমার সংযম-সৌজন্যের অভাব। সুদিনদা যে জালা জালা খায়, ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত ডোন্টো কেয়ারের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখায় সে-ও তোমাকে রীতিমতো সমীহ করে চলে। আমাকে বলে, ওরে মূর্খ! তোরা ভাবিস শিপ্রা বুঝি বেখেয়ালে আমাদের এটা-ওটা দেখতে পায়নি। ও মেয়ে না দেখেও সব দেখে, না শুনেও সব শুনতে পায়। আর আসল গেরো কী জানিস, তার আচরণ বা কথায় প্রকাশ পাবে না, সে অপরাধ নিয়েছে। তা হলে তো গেরোটা ফস্ করে খুলে যেত– হাত-পা ধরে মাপ চেয়ে নেওয়া যেত। বলে এটাই নাকি তোমার ব্রহ্মাস্ত্র।
শিপ্রা বললে, যাহ! বিশ্বভুবনটা রিফর্ম করার ভারটা কি আমার স্কন্ধে।
কিন্তু–
শিপ্রা বললে, আজ এসব অপ্রিয় আলোচনা এখানেই থাক। ইরানিরা যেরকম বলে, তখন আলোচনার কার্পেটটা রোল করে গুটিয়ে এক কোণে খাড়া করে রাখা হল। পরে
হয় আমরা ওটা আবার ঘরময় বিছিয়ে পুরনো আলোচনার শেষ রেশ ধরে নতুন করে ঢেলে সাজাব। আরেকটা কথা তোমায় বলি, কীর্তি। আমাকে যতশত গুণের গুদাম মনে করো না কেন, আমি অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করি দৈবে, অদৃষ্টে– আমি ফেটালিস্ট, অনেকটা খৈয়ামের মতো। তার প্রত্যাদেশ, তারই ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে পেয়ালা অধরে ধরো। অর্থাৎ আনন্দ করো। সেটা তো মোটামুটি মানিই, কিন্তু সবচেয়ে সেই ফরাসি বৃদ্ধ জেনারেল আমাকে যে ধর্মে দীক্ষা দেন :
লিবেরতে লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে।
.
১২.
খান সাহেবের সঙ্গে কীর্তির হঠাৎ মোলাকাত। খান সোৎসাহে বলে, হ্যাঁ রে, কিতে, এদানির তুই শিপ্রা বেগমকে দেখেছিস? আরে, ভাই, বয়স যেন দশটা বচ্ছর কমে গেছে। মোটরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে হাত নেড়ে নেড়ে যা প্যারটা জানাল, মাইরি, যেন আমি বহু বছরের লঙ লস্ট ব্রাদার। মেয়েদের ব্যাপারটাই ভানুমতীর খেল। আমি তো জানতুম বিয়ের জল পড়লে তবে না মেয়েদের জেল্লাই বাড়ে। কালা পেঁচিটা হয়ে যায় সোনালি ক্যানারি!
কীর্তি ভদ্রতার মৃদু হাসি হেসে বললে, শিপ্রা তো চিরকালের সুন্দরী।
খানের মাথায় অন্য চিন্তা। ব্যবসার। সে কথা কী শুকনো মুখে পাড়া যায়! বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছিস। তা চ, ঝপ করে একটা খেয়ে নিবি। ফাস্ট ক্লাস গর্ডনস।
এই অবেলায়?
বলিস কী রে? বেলা তিনটে অবেলা। চ-চ।
গুণীরা বলেন, অন্ধকার গুহায় আলো জ্বালালে সে অন্ধকার হাজার বছরের পুরনো হোক, আর দশ মিনিট পূর্বে কারও মশাল নিভে গিয়ে থাকার অন্ধকার থোক, দেশলাই দুটোকেই দূর করবে এক সময়েই, এক মুহূর্তেই। কিন্তু খান প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু কীর্তির। না যাব না বলে এক লহমায় সে বন্ধুতে আগুন ধরানো যায় না। আসলে কীর্তির ইচ্ছা ছিল পানের মাত্রাটা আস্তে আস্তে কমানো।
আরাম করে বসে খান ঢক করে পয়লা গেলাস বটম আপ করে কীর্তিকে বলল, হ্যাঁ রে, তুই তো কোথাও যাস নে। তবু একবার যদি আমার সঙ্গে আগরতলায়? তুই থাকলে কুচক্রীরা সমঝে যাবে, তোর শেয়ারসুদ্ধ, তুই আছিস আমার পিছনে। দু দিন আগে এরই ধাক্কায় আমাকে যেতে হল করাচি-লাহোরে।
কীর্তি হতভম্ব। তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর কি মাথা খারাপ? সেই হাইজ্যাকিঙের পর থেকে ওসব জায়গায় ইন্ডিয়ান হয়ে গেলি কোন সাহসে?
কীর্তির পিঠ চাপড়ে দিয়ে খান্ বলল, বেশ বাওয়া, বেশ। চতুর্দিকে নজর ফেলে ওকিবহাল হয়ে উঠছিস। এবারে ব্যবসার দিকে একটু মন দে না।
তা সেখানে কী দেখলি, কী শুনলি?
আর বলিসনি। ওদের কাগজগুলোর ক্রুড ছুঁচোর মতো ফিচেল মিথ্যে কথা বলার ধরন আর বহর দেখলে তোর মতো অগাও তাজ্জব মানবে। বলে কি না, আওয়ামী লীগ গুণ্ডা ভাড়া করে ইলেকশন জিতেছে। বিদেশি রিপোর্টারগুলো মিটমিট করে হাসে। আরে, ঝুট যদি বলবিই তবে বল্ হিটলারি স্টাইলে, গ্যোবেলসের সুপারফাইন সুতো দিয়ে বোন একটা মিহিন জাল। পুব বাঙলার পৃনের আনা লোক নাকি ইয়েহিয়াকে ফাদার-মাদার রূপে দেখে– মসজিদে মসজিদে তার জিন্দেগি আর ভালাই-এর জন্য দোয়াদরুদ পড়ে।