শিপ্রা একটা কুশনওলা লম্বা হেলান চেয়ারে আধ-শোওয়া হয়ে সামনের পার্কের দিকে তাকিয়েছিল। বললে, ট্যারচা হয়ে বসো আর আমার দিকে না তাকিয়ে তাকাও পার্কের দিকে। সবুজ দিয়ে চোখ ভরে নাও। আর ভয়টা কিসের, শুনি।
যেন প্রাণপণ সিংহের কেশর ধরে, মরি-বাঁচি ভাব মুখে মেখে বললে, মাত্র একটি কথা নিয়ে আমি সমস্ত রাত ভেবেছি। আমাদের যদি বিয়ে না হয় তবে তোমার যে নিন্দে হবে, সে কথাটা কি ভেবে দেখেছ।
শিপ্রা অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে সহজ গলায় বললে, আমি জানতুম তুমি এ কথাটা তুলবে কিন্তু তুমি না অপদার্থ? তা হলে এ দুশ্চিন্তা তোমার মাথায় ঢুকল কী করে? কলকাতা-বোম্বায়ের স্মার্ট সেটের যে কোনও বিবাহিত-অবিবাহিত জোয়ান-বুড়ো ক্ষণতরে চিন্তা না করে উল্লাসে নৃত্য করত আমার মতো মেয়েকে মিসট্রেসরূপে পেলে।
কীর্তি লাফ দিয়ে উঠে শিপ্রার মুখ চেপে ধরে বললে, মাথার দিব্যি দিচ্ছি, শিপ্রা, তুমি যদি ওই শব্দটা আর কখনও ব্যবহার করো তবে ওই তোমার পায়ের সামনে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব।
কীর্তির হাতে হাত বুলাতে বুলোতে বললে, আচ্ছা আর বলব না। তোমাকে তো দিব্যি কেটে বলেছি, আমি তোমার সব আদেশ মানব।
কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ওই দুশ্চিন্তাটার সঙ্গে মাখানো ছিল আমি পেয়েছি, আমি তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছি। এবং আমি জানি আমার যে তিনটি সত্যকার খাঁটি বন্ধু, সুদিনদা, শঙ্কর আর খান সায়েব এরাও ঠিক এইভাবেই আমার অনুগ্রহ লাভের কথা ভাববে।
শিপ্রা উঠে বসে বললে, আমার যে লোকনিন্দাটা হবে সেকথা শুনে আমি হাসব, না কাঁদব ভেবে পাইনে। লোকনিন্দার প্রাপকরূপে আমি ভেটার। আমার বয়স যখন মোল পেরুল সেদিন বাবা আমাকে ডেকে বললেন, আজ থেকে তুই এ বাড়ির মিসট্রেস আর আমি যেসব পার্টি দিই তাতে হোস্টেস্। বুঝলি? আর আমি আমার ইয়ারদের যে রকম পার্টি দিই তুই যেদিন দিবি সেদিন আমাকে ডাকতে পারিস, না-ও ডাকতে পারিস। বুঝলি তো? সেদিন দুপুরবেলা বাবা আমার ক্লাস-ফ্রেন্ডস্, স্কুলের সব টিচার এবং অন্যান্য যাদের কাছে পড়েছি আর আমার ফ্রেন্ডস ছেলে এবং মেয়ে দুই-ই সবাইকে দিলেন জব্বর একটা ভোজ। সেটাতে হোস্টেস হতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি যদিও বাবা নিচের তলায় নেমে আগের মতো একবারও তদারকি করেননি। শুধু খাবার সময় আমাদের হেডমিস্ট্রেসের পাশে বসে তাকে আদর-আপ্যায়ন করতে করতে আহারাদি করেছিলেন।
তোমরা আবার পার্টি করো! আর আমার পার্টিই-বা কী? কে এক সোভানি একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে ভরতনৃত্যের নামে হস্তীনৃত্য নেচেছিল! ওইখানেই তো ফুলস্টপ। বাবার পার্টিতে অন্তত জনা পাঁচেক বেহুশকে স্ট্রেচারে করে গাড়িতে তুলতে হত। জনা দশেককে দুজন তাগড়া জোয়ান বেয়ারা দু দিক থেকে স্যান্ডউইচ করে মোটরে তুলে দিত।
অবশ্য বাবা আমাকে বিস্তর টিপস আগের থেকেই দিয়ে রেখেছিল। একটা এখনও মনে আছে। যদি লক্ষ করিস কেউ একটু বে-এক্তেয়ার হয়ে যাচ্ছে তার পাশে গিয়ে বসবি। তাকে আদর-সোহাগ করে বলবি, আকল, তুমি তো জানো, আজ থেকে আমি হোস্টেস। আমার ভারি ইচ্ছে আমি নিজে তোমাকে ড্রিংক দিই। তুমি কোনও বেয়ারার ট্রে থেকে ড্রিংক তুলবে না। কথা দাও। কথা নিজেই দেবে। খাস হোস্টেসের কোনও অনুরোধ কোনও লোক উপেক্ষা করে না। তার পর বার টেবিলে গিয়ে যে ড্রিংকই হোক না সেটা বেয়ারাকে পাতলা করে দিতে বলবি। তাকে বোঝাতে হবে না। তার পর খামকা টালবাহানা করে, এর-ওর সঙ্গে দুটো কথা কয়ে বেশ দেরি করে এসে তোর সেই আনককে গেলাসটা আপন হাতে রেখে প্রথম তো হাজার দফা মাফ চাইবি তার পর জুড়ে দিবি লম্বা এক কাহিনী –গেলাসটা কিন্তু হাতে। গল্প শেষে গেলাস দিবি। তোর আন্কটিও চক্ষুলজ্জায় তোর কাছে ঘন ঘন ড্রিংক চাইবে না। আর কেউ যদি নিতান্তই বেহেড টালমাটাল হয়ে যায় তবে মজুমদার, কাঞ্জিলাল, ভবতোষ এদের কাউকে একটু হিন্ট দিয়ে আসবি। ওদের মাথা ঠাণ্ডা। সব সঙ্কটে মুশকিল-আসান।
পার্টি শেষ হল। বাবা ভারি খুশি। বললেন, একদিন তুই যে শহরেই যাস না কেন, নামজাদা হোস্টেস হবি। দু চারটে পার্টি করার পর মজুমদার, কাঞ্জিলালকেও তোর দরকার হবে না।
কিন্তু সেইদিন থেকেই আমার বদনাম শুরু। বিস্তর লোকের মুখে ছ্যা ছ্যা। বিশেষ করে মেয়েদের। এমনকি বাবার স্কুলফ্রেন্ড চৌধুরী সাহেব বাবাকে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, এটা ঠিক হল না। বাবা বলেছিলেন, দেখো, চৌধুরী, তুমি খানদানি মুসলমান ঘরের ছেলে। তোমার চতুর্দশ পুরুষে কেউ মদ খায়নি তবু তুমি মদ ধরেছ। শুনেছি অভ্যাসটা নাকি মুসলমানদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। আর হিন্দুদের তো কথাই নেই। নিত্যি নিত্যি নতুন নতুন বার খুলছে এবং সেগুলো ভর্তি। বেশিরভাগ ক্লাবে আসে সুদুমাত্র মদ খেতে। আর ড্রিংক পার্টির কথাই নেই। আমার মেয়ে অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, সে আমি জানি তার ছোট্ট বয়স থেকে। তদুপরি তার হিউম্যান ইনট্রেস্ট অফুরন্ত। চাকরবাকররা তাদের বাড়িতে তাদের সমাজে কী করে, না করে তার থেকে আরম্ভ করে সে কুইন ভিক্টোরিয়ার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বর্ণনা খুটিয়ে খুটিয়ে জেনেছে। এ মেয়ে পাটিতে যাবে সেটা প্রায় অসম্ভব। তাই পার্টিতে, ক্লাবে বার-এ একটা ভদ্রমেয়ের আচরণ কীরকম হওয়া উচিত, সেসব জায়গার এটিকেট মেনে নিয়ে ভদ্রতা শালীনতাসহ কীভাবে মেলামেশা করবে, সেটা আমার কাছ থেকে শিখবে, না শিখবে ওইসব পাঁড় মাতাল ভেঁপো ছোঁড়াদের কাছ থেকে কোনও ক্লাবে বা পার্টিতে কেউ যদি অশালীন আচরণ করে তখন কীভাবে চতুরতা এবং ডিপ্লোমেসির সঙ্গে নিজের ভদ্রতা নিজের ডিগনিটি বাঁচিয়ে তাকে ট্যাকল করতে সে-সব শেখাবে ওইসব ছোঁড়ারা? আর শুধু কী তাই? আজ তাকে বলে রেখেছিলুম সে যেন কর্নেল সরকারের টেবিলে দু এক সিপ চাখে। আস্তে আস্তে তাকে ভোদকা আবসাতেরও দ্রব্যগুণ শেখাব। কোনটা কতখানি ক্ষতি করে, ও জেনে নেবে। তার পর কারও পাল্লায় পড়ে যা তা গিলে নিজের অনিষ্ট করবে না, বানচালও হবে না, কাকে কতখানি কী ঢেলে দিতে হবে সেটাও জেনে যাবে– হবে আইডিয়াল হোস্টেস। বাপের চেয়ে ভালো গুরু সে পাবে কোথায়?