প্রায় নৃত্য করতে করতে বার বার বললেন, মাদৃমোয়াজেল, মাদৃমোয়াজে। অর্থাৎ, কল্যাণী, কল্যাণী।
সে তো বুঝলুম– ফরাসিরা ওইভাবে বে-এক্তেয়ার হয়। তার পর কী বলতে চান তিনি? আর আমিই-বা এমন কোন গূঢ় গুহ্য মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক ট্যাকটিকাল প্রশ্ন শুধিয়েছি যে ঝানু জাঁদরেল আত্মহারা হবেন!
আমার পাশে আসন নিয়ে কিঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর বললেন, আমি বড্ড ভুল করেছি, মাদমোয়াজেল, বড় ভুল বুঝেছি এতদিন ধরে। আমি মনে করেছিলাম, তুমি। লন্ডন-প্যারিস সমাজে বাস করে করে দেশাত্মবোধ হারিয়ে ফেলেছ, কিন্তু এখন আমি দেখছি তুমি দেশের স্বার্থ, দেশের বিপদ সম্বন্ধে বেশ সচেতন। প্রশ্নটা তো অতিশয় সাদাসিধে, কিন্তু তারই ভিতর দিয়ে আমি তোমার অন্তরের অন্তস্তল অবধি দেখতে পেয়েছি।
শোনো, মাদমোয়াজেল, স্ত্রী হোক পুরুষ হোক, সবচেয়ে মূল্যবান ধন মানুষের মনুষ্যত্ব। কিন্তু আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস সেটাতে মানুষ পৌঁছয় দেশাত্মবোধ, ন্যাশনালিজম, পেট্রিয়টিজমের ভিতর দিয়ে এবং তার দৃঢ় ভূমি–
শিপ্রা বলল, অবাক মানবে, কীর্তি, তার পর সেই বৃদ্ধ জেনারেল এক লাফে কোচ ছেড়ে, যেন অদৃশ্য এক পতাকা এক হাতে উঁচু করে ধরে, রাস্তার ছোকরাদের মতো ঘরময় নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগলেন,
লিবেরতে, লিবেরতে, তুজুর লা লিবেরতে
লিবার্টি, লিবার্টি, অলওয়েজ লিবার্টি
স্বাধীনতা স্বাধীনতা, স্বাধীনতা চিরদিনের।
.
১০.
উপরে চল। আমার কোনও বান্ধবী, বন্ধু দূরে থাক, কেউ কখনও দোতলায় ওঠেনি। বাবা কাউকে উপরে আনতেন না বলে আমি সে রীতিটা এখনও মেনে চলি। কিন্তু তোমাকে এখন সবকিছু দেখে-চিনে নিতে হবে। তুমিই মালিক। যদি চাও, বাড়ি-ঘর যা কিছু আছে, উইল করে তোমার হাতে সঁপে দেব।
কীর্তি আঘাত পেল; বললে, তুমি কি আমাকে এখনও চিনতে পারোনি?
শিপ্রা তাড়াতাড়ি বললে, সরি, আমি দুঃখিত। এই হল বাবার স্টাডি। এখানে বসে তিনি বৈষয়িক কাজকর্ম করতেন। আমার খেয়াল-খুশিমতো ওই কোণের কোচটাতে বসে খবরের কাগজ, বইটই, মাঝে মাঝে শেয়ার মার্কেট রিপোর্ট পড়তুম। আমি জানতুম তিনি তাতে খুশি হতেন। কাজ করতে করতে কখনও গুনগুন করতেন, খুশি হলে শিস্ দিতেন। কোনও কারবার ঠিক তার পছন্দমতো না এগোলে গরগর করে বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আর প্রায়ই মাথা তুলে বেশ উঁচু গলায় বলতেন, দিজ আর লুকিং আপ, আমাকে শুধোতেন, তোর জন্য শ-খানেক চা-বাগানের শেয়ার কিনব? আমি শুধু একটু মুচকি হাসতুম– আমি ও-সবের কীই-বা বুঝতুম, তখন? কিন্তু আমাকে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য শেখাননি। বলতেন, এসব শুকনো জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মানুষের প্রাণরস শুকিয়ে যায়–আমি অবশ্য কখনও তাঁর প্রাণরসে ভাটার টান পড়তে দেখিনি। শেষটায় বলতেন, তোকে কিচ্ছুটি শিখতে হবে না। তুই পেয়েছিস আমার ঠাকুমার বুদ্ধি এবং বিশেষ করে বিচক্ষণতা। বাবা পেয়েছিল তার বুদ্ধির বারো আনা, আমি পেলুম আট আনা, তোতে ফের এক্কেবারে ফুল হাউস ন সিকে। যেদিন দরকার হবে পুরো হপ্তাটাও লাগবে না, তুই হয়ে যাবি শেয়ার মার্কেট কুইন, কিংবা মফৎ লাগল এবং দেওকরণ নানজির সমন্বয়। এবারে চলো এগিয়ে।
বিরাট জোড়া খাটের বেডরুম। একশো বছরের পুরনো স্টাইলের।
শিপ্রা বলল, এখানে বাবার আর একটা ড্রইংরুম আর গেস্টরুম আছে। তবে এগুলো কখনও ব্যবহার হয়নি। এইখানে বাবার হিস্যে শেষ। এই আমার বেডরুম।
ছবিতে কীর্তি ফরাসি ধনী কুমারী কন্যার বেডরুম দেখেছে। এবারে আপন চোখে দেখল।
দেওয়ালে ওয়ালপেপারের বদলে খুব দামি সিল্কের ওয়ালকাভার। তার উপর আবার ভিন্ন ভিন্ন রঙিন সিল্ক দিয়ে বেহালাতে জড়ানো ফুলের মালার ডিজাইন। ছাতের চার কোণে চারটি দেবশিশুর বা-রিলিফ। তাদের হাত থেকে ঠিক মাঝখানে এসেছে চারটে ফুলের মালা। সেগুলো যেন ঝুলিয়ে রেখেছে একটা ফোয়ারার পাদপীঠচক্র। পায়ের নিচে ফরাসি কার্পেট।
আর খাটটি ঘোট এবং সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরা। খাঁটি ফরাসি পালঙ্ক। এমনকি তিনদিকে ফরাসি কায়দায় সিল্কের কার্টেন ঝুলছে। বেড-কাভার ভারী কিন্তু সুতোগুলো অতি মিহিন। কার্টেন আর বেড-কাভারের ডিজাইন দেয়ালের সিল্কের সঙ্গে ম্যাচ কিন্তু মতিফ ভিন্ন– এখানে জলে চালিত ময়দা পেশার ওয়াটার-মিল ডিজাইন। ঘরের এক কোণে ড্রেসিংটেবল– তার উপর বিচিত্র ঢপ-ঢঙের বিস্তর শিশি-বোতল, এক সারি কৌটো– অথচ কীর্তি খুব ভালো করেই লক্ষ করে বুঝেছিল, শিপ্রা প্রসাধন করে সামান্যতম। সমস্ত ঘরটার কালার স্কিম মভ রঙের।
শিপ্রা বলল, আমার অত বাহার সয় না। বাবা করিয়েছিলেন টপ টু বটম।
পাশে শিপ্রার একান্তে বসার বুদওয়ার। তার মধ্যে দ্রষ্টব্য, মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট এবং প্রায় সম্পূর্ণ একটা প্রান্তজুড়ে বিরাট দৈত্যপ্রমাণ গ্র্যান্ড পিয়ানো।
কীর্তি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, তোমাকে তো কখনও পিয়ানো বাজাতে শুনিনি।
শিপ্রা বলল, আমার বাজনা শোনাবার মতো নয়। মাত্র দশ বছরের হেঁ ছেঁড়া রেওয়াজে শোনাবার মতো হাত পাকা হয় না। আমি বাজাই রাত ঘনালে আর অতি ভোরে। এবারে চলো ব্যালকনিতে।
.
১১.
ভেবে নিয়েছ? অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেছ? এখনও ব্যাক-আউট করার সময় আছে?
কাতর কণ্ঠে কীর্তি বললে, সমস্ত রাত ভেবেছি। কিন্তু কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আর ভয়ও করছে।