তাই বলছিলুম, এ ছুঁচোমোটা কেন? তুই ইয়েহিয়া, তুই বাবা প্রেসিডেন্ট ডিকটেটর যা-খুশি তাই নিবি তো নে। পুব বাঙলার লোক যদি তোর আদেশ অমান্য করে তবে চালা তোর বন্দুক কামান। আজকের দুনিয়া পরশুর ইতিহাস বিচার করবে ধর্মাধর্ম।
ডিকটেটর হ আর যাই হ তোর আসল স্বত্বটা কী? এবাভ অল তুই আমিম্যান, অফিসার। তোর শরীরের রক্ত, বাইরের চামড়া অফিসারের ধাতু দিয়ে তৈরি। তোর ধর্ম, আত্মগৌরব আত্মসম্মানবোধ। অনার। কথা দিবিনি, দিসনি। কিন্তু একবার দিলে জান কবুল। কী দরকার ছিল তোর গণতন্ত্র ফের চালু করার তরে ওয়ার্ড অব অনার দেবার? কী দায় পড়েছিল ইলেকশন করার? আর এখন হল কী? সোলজার, অফিসার হয়ে তুই তোর শপথ ভঙ্গ করলি, তোর স্বধর্ম ত্যাগ করলি। ভদ্র দেশ হলে অফিসারস ক্লাব থেকে তোর নাম কেটে দিত। ছা!
এতক্ষণে আসমানের বেপরওয়া চিড়িয়া কীর্তিবাবুর কানে জল গেল। তা-ও যেত না যদি না পরশু রাতে তার দেবীর প্রসন্ন বয়ান নির্গত তাপহরা বিন্দু বিন্দু অমৃতবারি তার ব্যথাভরা হিয়াটাকে সদ্য ফোঁটা বেলফুলের মতো বিকশিত করে দিত। সে-রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে শপথ নিয়েছিল, দেবীর পথ তার পথ। পরের দিন ভোরবেলা ইংরেজি কাগজটা তো পড়লই, একটা নেটিভ বাঙলা কাগজের খয়ের খা ভি হয়ে গেল। কিন্তু দু দিন ধরে অনভ্যাসে ফোঁটা চড়চড় করছিল বড্ডই। দুনিয়ার বেকার হাবিজাবি না দিয়ে কাগজ ভর্তি করা যায় না? অধিকাংশ খবরের অর্থ কী উদ্দেশ্য কী তার কোনও হদিসই পাচ্ছিল না সে। আজ যদি কোনও নিরীহ বাঙালি হঠাৎ নটিংহামের একটা লোক্যাল ডেলি পড়তে বসে তবে তার যা অবস্থা হবে কীর্তির হল তাই। কিন্তু তার কপাল ভালো, কালকের বাঙলা কাগজে আওয়ামী লীগের একটি সমসাময়িক ইতিহাসমূলক প্রবন্ধ ছিল। যাই বল, যাই কও, কীর্তির বাপঠাকুদ্দা স্রেফ মাথা খাঁটিয়ে এন্তের টাকাকড়ি কামিয়েছিলেন। ম্যান-ইটার বাঘের বাচ্চা তো আর ভেড়ার ছানা হয় না–কীর্তির খুলিটাতে বেশ খানিকটে বংশলব্ধ মদ্যসিক্ত অর্ধসুপ্ত প্যাচালো ঘিলু বাবুর খোঁচাতে জেগে ওঠবার তরে তৈরি ছিল। পাকা নায়েব যেরকম শহুরে কাঁচা বাবুকে জমিদারির হালটা দু দিনেই বেশ খানিকটে বুঝিয়ে দেয়, এ ক্ষেত্রেও হল তাই।
সদ্যলব্ধ বিদ্যে ফলিয়ে বলল, ওই ইয়েহিয়া ঘুঘুর পেছনে রয়েছেন আস্ত একটা খাটাশ মিলিটারি ক্লিক।
শিপ্রার চোখের পাতা স্তব্ধ– যেন অর্ধাঙ্গে অবশ। এ কী কথা শুনি আজি? দুনিয়ার তাবৎ বাবদে বেহদ্দ বেখেয়াল বেকুব নীচ কুলোদ্ভবা দাসীর মুখে সত্য মিথ্যা জ্ঞান তার তবে কী সম্ভবে? কীর্তির মুখে মোস্ট আপ টু ডেট ইনসাইড স্টোরি।
বিমূঢ় ভাব কেটে যাওয়ার পর শিপ্রা শুধু বলল, তুমি না অপদার্থ কীর্তি?
প্রশ্নটা যেন অদৃশ্য ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ছো, এ খবরটা আবার পদার্থ। খবরের কাগজ থেকে যে তত্ত্ব আধ ঘন্টার ভিতর জোগাড় করা যায়।
শিপ্রা আরও সাত বাও পানিমে। বলল, খবরের কাগজ? ওসব ব অভ্যাস হল তোমার কবের থেকে?
কীর্তি সবিনয় : সে অনেক কথা, পরে হবে।
শিপ্রা : তাই সই, তুমি যখন এসব বুঝতে আরম্ভ করেছ তখন তোমাকে আর একটা খবর জানাই। সেই যে বাবার দোস্ত বুড়ো ফরাসি জাদরেল বাঙলাদেশের মিলিটারি হিন্দ্রি জোগাড় করার চেষ্টা দিয়েছিলেন– নিছক আমরা ওই দেশের লোক বলে। এটাও একরকম দরদি হিয়ার আচরণ বলতে পারো। একদিন বাবাকে কথায় কথায় বললেন, ব্লাঙ্কো, ব্লাঙ্কো! প্রায় কিছুই জোগাড় করতে পারিনি। তবে দিল্লিতে লেখা এন্তের রাজনৈতিক ইতিহাস পেয়েছি বেশকিছুটা। তার থেকে স্পষ্ট ধরা পড়ে দিল্লির হুজুররা বেঙ্গলে মার খেয়েছেন বিস্তর। তাই সে সম্বন্ধে নীরবতাটাই সমধিক। গ্রেট মোগল আকবরের নাম এদেশের লোকও শুনেছে। তিনিও দেখলুম বাঙলাদেশের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র জয় করতে পেরেছিলেন। জয় করেছিলেন তার ছেলে জাহাগির। মন্দ কপাল আমার, তার স্ট্র্যাটেজি খুঁজে পেলুম না।
কিন্তু যা পেয়েছি তার থেকে আমি বুঝেছি, এবং জোর গলায় বলতে পারি।
তেরাঁ, তেরাঁ, পুনরপি তেরাঁ
মল্লভূমি, মল্লভূমি, মল্লভূমি
এই বিরাট পৃথিবীতে আদ্যন্ত অদ্বিতীয়। বিরাট বিরাট নদী আর পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি যেখানে হয় সেই চেরাপুঞ্জি থেকে নামে আকাশের জল। দুয়ে মিলে এমন সব ভিন্ন। ভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির জলাভূমি তৈরি করে যে সেগুলোর নাম ইয়োরোপীয় কোনও ভাষায় নেই। দেশি শব্দের একটা সুর মনে আছে হাওর না কী যেন। এমনকি মস্কো যেতে পথে যে জলোজমি সেটাও হিটলার পেরিয়ে যেতে পেরেছিল কিঞ্চিৎ লোকক্ষয় স্বীকার করে। কিন্তু তোমাদের দেশে আমাদের সনাতন সংগ্রাম পদ্ধতি চলবে না।
শিপ্রা বলল, আমি এসব আলোচনায় যোগ দিতুম না। তখন সেই প্রথম বললুম, কিন্তু, মসিয়ো ল্যা জেনারেল, আকাশে থেকে বমিং? জেনারেল তো গড্ড্যাম গ্ল্যাড। আপন চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার কাছে এসে ফরাসিরা ভাবাবেগে, আনন্দোল্লাসে উত্তেজিত হলে যা করে তাই করলেন। সর্বপ্রথম আমার গালে খেলেন শুকণ্টকিত কিন্তু অতিশয় মিঠে মিঠে একটি চুম্বন, তার পর আমার চুলের উপর বুলোলেন তাঁর হাত, এবং সর্বশেষে রাজপ্রাসাদীয় কায়দায় দিলেন আমার বাঁ হাতটি তুলে ধরে একটি অতিশয় রিফাইনড চুম্বন।