তুমি যে আনন্দসাগরে ডুবে আছ সেটাতেই তুমি থাকবে– শুধু আমাকে পাবে পাশাপাশি।
হায়রে কলকাতার রোমান্টিক সুখনীড় থেকে দূরে এসে পথপার্শ্বে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যুগ্ম ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে সর্বপ্রকার কবিত্ববর্জিত সাদামাটা ভাষায় আলোচনা করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা!
এ বিশ্বাস অবশ্য শিপ্রার পরিচিত জনের ছিল যে, সে যদি কখনও প্রেমে পড়ে তার স্যাঁতসেঁতে হৃদয় বাঙালির মতো রসসায়রে হাবুডুবু খাবে না, তার প্রেম হবে পাক্কা ইংরেজি কায়দায় বিজনেস ইজ বিজনেস হোক না লেনদেনের বস্তু ওক কাঠের তক্তার স্থলে যুবক-যুবতীর প্রেম।
কিন্তু এর পরই কৌতূহল জাগার কথা, শিপ্রার বক্তব্য শুনে– তা সে রোমান্টিক ভাষাতেই হোক কিংবা কাঠখোট্টা কাঠের ভাষাতেই হোক আমাদের অপদার্থ কীর্তি ঠাকুরের হৃদয়মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল।
এ কাহিনী যদি প্রেমের মোলায়েম গদ্যকাব্য হত তবে তারই সরস বর্ণনা দিয়ে হেসে-খেলে দু দশ অধ্যায় জুড়ে বিরাট রসসৌধ নির্মাণ করলে যুবজন উল্লসিত হতেন। কিন্তু এ স্থলে এই যুবক-যুবতী অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে, সে পথে প্রেম-রস মুখ্য নয় গৌণও নয়- সেটি তাদের পাথেয়।
আত্মম্ভরিতার গ্যাসে ভর্তি বেলুনমুণ্ড অকালকুষ্মও ভিন্ন অন্য যে কোনও সাদামাটা বাঙালি প্রেমমুগ্ধজন তার প্রতিদান পেলে এতই আত্মহারা হয় যে সে আর তখন প্রিয়ার অন্য কথা শুনতে পায় না। অনাগত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তার সাবধানবাণী, দুজনার শান্তিময় জীবনযাপনের জন্য সামান্য দু একটি বোঝাঁপড়ার কথা কিছুই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। হারানো ছেলে ফিরে পেলে দুখিনী-মায়ের চতুর্দিকময় ঘন অন্ধকার যেরকম একমুহর্তে অন্তর্ধান করে, কীর্তির বেলা হল তাই।
তার চেতনায় মাত্র একটি অনুভূতি পেয়েছি, পেয়েছি, পেয়েছি।
এই আনন্দলোককে লণ্ডভণ্ড করবে কোন পাষণ্ড!
শিপ্রা তার মধুরতম হাসি দিয়ে কীর্তিকে নিরঙ্কুশ আত্মহারা করে দিয়ে বলল, কীর্তি, তুমি যে আনন্দসায়রে অবগাহন করছ সেটাতে আমি ঝড়তুফান তুলতে চাইনে। আমার যা বলার সেটা বলা হয়ে গিয়েছে। তুমি রসসায়র থেকে ওঠার পর তাই নিয়ে চিন্তা করে যদি কিছু বলার থাকে, কাল বল। উপস্থিত তোমার সায়র থেকে যে দু চারটি মুক্তো আহরণ করেছ সেগুলো দেখাও।
সে যাত্রা আর বোলপুর হল না। সামনে ময়ূর সিংহাসন। সেটা ছেড়ে কোন মূর্খ ধায় কাবুল-কান্দাহার পানে সেখানে মোড়ার উপর বসবে বলে।
.
০৯.
কীর্তি আসামাত্রই শিপ্রা উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, পড়েছ কাগজে পাজির পা-ঝাড়াদের ছুঁচোমোটা?
কীর্তি হবার মতো তাকিয়ে রইল।
শিপ্রা বললে, বাবার সঙ্গে যখন প্যারিসে ছিলুম তখন ফরাসিদের মিলিটারি অ্যাকাডেমি স্যাঁ সিরের কয়েকটি অফিসার বাবার সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুনিয়ার যতরকমের বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। একদিন কী একটা মিলিটারি প্রশ্ন উঠলে তারই খেই ধরে যে চারটি কথাবার্তা হল তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল আর পাঁচটা বাঙালির মতো বাবা মিলিটারির কিছুই জানে না– এস্তেক মিলিটারির ইতিহাস যা কি না সহজপাঠ্য– তা-ও পাল্টে দেখেনি। অফিসারগুষ্টি তো বিস্ময়ে নির্বাক। শেষটায় এক জাঁদরেল বলল, মসিয়ো, এ কী অদ্ভুত ঠাসবুনোট-জড়োয়া কাশ্মিরি শালের মাঝখানে একটা বিরাট ফুটো। পাশ্চাত্য সাহিত্য চিত্রকলা বিশেষ করে জুরিসপ্রুডেনস থেকে আরম্ভ করে হেন বিষয় নেই যেটা আপনি হজম করে আপন সিস্টেমে বেমালুম মিশিয়ে নেন, আর মিলিটারি সায়েন্সের কিছুই জানেন না, এ যে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!
বাবা একটু সলজ্জ ভাষায় বললেন, ইংরেজ দু-শ বচ্ছর ধরে বিশেষ করে বাঙালিদের ওই জিনিসটার দিকে ঘেঁষতে দেয়নি। পাখি মারার সামান্য একটা শটগান জোগাড় করতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। মিলিটারি সায়েন্স তো প্যোর-ফিজিকস নয় যে পুরনো খামের উল্টো পিঠে তার ফরমুলা লিখে কর্ম খতম করা যায়।
তারা তখন উঠেপড়ে লেগে গেল বাবাকে ওই বিষয়টি শেখাবেই শেখাবে। কাহা কাঁহা মোকামে নিয়ে গিয়ে কী সব দেখাত বোঝাত খোদায় মালুম। ফরাসিদের যে সবচেয়ে বিরাট কলেবর বন্দুক কামানের কারখানা স্লাইডার সেটা পর্যন্ত দেখিয়েছে।
কিন্তু এহ বাহ্য। শামিয়ানা সাইজের বৃহৎ বৃহৎ বান্ডিল বান্ডিল ম্যাপ পাতা হত কার্পেটের উপর, এবং সব্বাই তারই উপর উপুড় হয়ে স্টাডি করতেন ইতিহাসের নামজাদা সব ক্যাম্পেন–নেপোলিয়নের আউস্টার লিৎস থেকে আরম্ভ করে এদানির ডি ডে নরমালি ল্যান্ডিং। একদিন কোত্থেকে জোগাড় করে এনেছিল বাবুর বাদশার পানিপথ লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি। সেটার অধ্যয়ন শেষ হলে ফরাসিরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বার বার বলছিল, ফাতাসতিক, ফরামিদাবল– নে স পা? অর্থাৎ ফ্যানটাসটিক, ফরমিডেবল নয় কি? কিন্তু এহ বাহ্য!।
একটু দম নিয়ে তার পর শিপ্রা বলল, কিন্তু যে কথা বলতে চাইছিলুম সেটা এ সবের বিচিত্র স্মৃতির চাপে প্রায় ভুলে যেতে বসেছিলুম। সবচেয়ে আমাকে মুগ্ধ– মুগ্ধ কেন, আত্মহারা করেছিল এদের আদব-কায়দা, এদের অপরিসীম সৌজন্য ভদ্রতা। এবং সর্বোপরি তাদের তীব্রতম আত্মসম্মানবোধ কাউকে কোনও কথা দিলে সেটা রাখবেই রাখবে– যায় যা তাতে তার শেষ ফ্রা। এবং সেটা দিয়েও যদি শেষ শোধবোধ না হয় তবে সোজা রাস্তা রয়েছে নাক বরাবর। কপালে পিস্তলটি রেখে গুড়ুম!..