অবশ্য নিঃসন্দেহে বলতে হয়, শিপ্রার চাণক্যদত্ত এই কূটনৈতিক দক্ষতার খবর জানত অতি অল্প লোকই। সর্বসমক্ষে সে তাবৎ পার্টির প্রাণ, তাবৎ ক্লাবের জান্।
সেই শিপ্রা এই অপদার্থ কীর্তিটাকে কী তবে বাদরনাচ নাচাচ্ছে?– যদিও সে যে শিপ্রার প্রসাদ পেয়েছে সেটা মাত্র দু দিনের ভিতর কারওরই জানার কথা নয়। কাল যে পার্টি হয়ে গেল সেখানেও কীর্তিবাবু ছিলেন ঐতিহ্য অনুযায়ী পূর্ববৎ পার্টিফিন্ডের লাইনসম্যান। কোথায় ভুবন-ভাগানের ক্যাপটেন শিপ্রা, আর কোথায় সে!
কিন্তু বাঁদরনাচ নাচানো মেয়ে শিপ্রা নয়।
শিপ্রা তাকিয়ে আছে অলস নয়নে রাস্তার দিকে। সাঁওতাল মেয়েরা জোড়ায় জোড়ায় একে অন্যের আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নিচু গলায় কোরাস গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে হাট থেকে কেনাকাটা সেরে। সাওতাল পুরুষের চিহ্নমাত্র নেই। একটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু চলেছে জোড় না মিলিয়ে। হাতে একটা কঞ্চি। সেটা দিয়ে কখনও-বা আস্ফালন করে, কখনও-বা দু কদম নেচে নেয়, কখনও-বা কঞ্চি দিয়ে অন্য মেয়েগুলোকে শাসায় আর তারা খিলখিল করে হাসে। আসলে সাঁওতাল মেয়েরা হাটেবাজারে তাড়িকাড়ি খায় না। এ মেয়েটা ব্যত্যয় এবং সাতিশয় ব্যত্যয়। বেশ খানিকটে গিলেছে। তাই তার এই ফুর্তি।
শিপ্রা তাড়াতাড়ি কীর্তিকে দৃশ্যটা দেখিয়ে বললে, দেখো দেখো, এই মেয়েটা হচ্ছে আমার সাওতাল সংস্করণ– ওদের সোসাইটি গার্ল।
কীর্তি প্রথমটায় আদৌ বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা কী। বললে, ছিঃ! এ মেয়েটা তো রীতিমতো বে-এক্তেয়ার।
শিপ্রা বললে, আহা, তুমি কিছু বোঝ না। ভিন্ন ভিন্ন সোসাইটির ভিন্ন ভিন্ন প্যাটার্নের বে-এক্তেয়ারির রকমফের হয়। আমাদের অজ পাড়াগাঁয়েও দু একটি মেয়ের উড়কু উড়ুক্কু ভাব থাকে তোমরা যাকে বল, ফ্রাইটি গার্ল, একেবারে যেন শব্দে শব্দে অনুবাদ। তার ফষ্টিনষ্টি আর প্যারিসিনীর অর্ধোন্মত্ত তাণ্ডব লম্ফঝম্ফ কি একই প্যাটার্নের তবে হ্যাঁ, যেখানে মদের প্রচলন নেই সেখানে এসব ব্যাপারে মাত্রাধিক্য হয় না। তার পর বেশ কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করে বলল, জানো কীর্তি, আমি অনেক দেশ দেখেছি; আমার জানা মতে পুব বাঙলার একটা বৈশিষ্ট্য যে ওরা মদ খায় না। চাষাভূষো তাড়ি খায় না, মধ্যবিত্তদের তো কথাই নেই আর পার্টিশনের আগে পর্যন্ত বড় বড় বেশকিছু জমিদার কলকাতায় বাড়ি বানাত ফুর্তিফার্তি এবং মদ্যপানের জন্য। ছোট্ট কুর্দিস্তানে কী হয় জানিনে কিন্তু পুব বাঙলার মতো একটা মাঝারি রকমের দেশে মদের প্রচলন নেই, এটা সত্যই বিচিত্র ঠেকে আমার কাছে। ওদের কালচারটাই যেন বর্ধমান বীরভূম এক কথায় রাঢ়ের থেকে স্বতন্ত্র।
কীর্তি বললে, হুঁ। কিন্তু ঢাকা বেতার যা রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় সেটা কলকাতার চেয়ে কোনও অংশে খারাপ নয়। তবে পিন্ডির রাজারা সেটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।
শিপ্রা বাঁকা হাসি হেসে বললে, তুমি অতশত খবর রাখো কী করে। তুমি না অপদার্থ।
.
০৮.
কীর্তি।
ইয়েস, ম্যাডাম।
ঠাট্টা নয়। তোমাকে গুটিকয়েক কথা বলতে চাই।
দোহাই তোমার। আমি বড় আনন্দে ডুবে আছি। দয়া করে সেটাকে থাকতে দাও।
তুমি যদি আমার কথাগুলো ঠিকমতো গ্রহণ করো, তোমার ভিতর যে স্বাভাবিক বুদ্ধি আছে তারই সাহায্য নিয়ে আমার কথাগুলো বুঝে নাও তবে তোমার আনন্দ কিছুমাত্র কমবে না। কলকাতায় আমার ঘরে শুয়ে শুয়ে তোমাকে যে এ কথাগুলো বলা যেত না তা নয়। কিন্তু তুমি একাধিকবার বলেছ, আমার স্বরটি বড় রোমান্টিক। সেখানে যে আবহাওয়ায় তুমি কী বুঝতে কী বুঝবে, কী বলতে কী বলবে তার জন্যে পরে হয়তো পস্তাবে। তাই তোমাকে এখানে টেনে এনেছি। এখানে চতুর্দিকে লোকজন রয়েছে। হঠাৎ হৃদয়াবেগে আমার হাঁটু জড়িয়ে হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারবে না, আমিও তখন সর্ব সঙ্কল্প ভুলে গিয়ে তোমার কান্নায় গলে যাব না।
বেচারা কীর্তি কোন দিকে যে হাওয়া বইছে কিছুই অনুমান করতে পারছিল না। স্তব্ধ হয়ে শুধু শিপ্রার দিকে তাকিয়ে রইল।
শিপ্রাও সোজা স্থির পূর্ণ দৃষ্টিতে কীর্তির দু চোখে আপন দু চোখ রেখে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, আমি তোমার চেয়ে ছ বছরের বড়, কিংবা বেশি, কম নিশ্চয়ই নয়। আমাদের বিয়ে হতে পারে না। শিপ্রা সজ্ঞানে কথা বন্ধ করল। হয়তো-বা কীর্তির মুখ থেকে কোনও মন্তব্য প্রত্যাশা করছিল। হয়তো-বা তার প্রত্যেকটি বক্তব্য যেন অক্ষরে অক্ষরে, তার সম্পূর্ণ অর্থ নিয়ে কীর্তির বোধগম্য হয় তার জন্য আপন নীরবতা দিয়ে তাকে সুযোগ দিচ্ছিল।
কিন্তু কোনও উত্তরই দিল না। কিন্তু সে যে বক্তব্যটা বুঝতে পেরেছে সেটা তার মুখের ভাব পরিবর্তন থেকেই বোঝা গেল।
শিপ্রা ঠিক আগেরই মতো স্বাভাবিক কণ্ঠে বললে, কিন্তু তারই ফলে আমাদের ভালোবাসাতে সামান্যতম আঁচড়টুকু লাগবে না, আমাদের ভালোবাসাতে কোনও দিক দিয়ে কোনওপ্রকারের অসম্পূর্ণতা থাকবে না। কারণ আমি স্থির নিশ্চয় জানি, আমার সর্ব সত্তা দিয়ে অনুভব করেছি, তোমার ভালোবাসা একাগ্র ভালোবাসা, তুমি আর তোমার প্রেম অভিন্ন সত্তা; আর আমার প্রেম তুমি দিনে দিনে চিনে নিয়ো, আমি আশা ধরি, তুমি কোনওদিন তার শেষ অতলে পৌঁছতে পারবে না। এবং তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বলি, এই কলকাতার শহরে শত শত গতানুগতিক যেসব বিয়ে হচ্ছে সেখানে বর যা পায় তার চেয়ে তুমি পাবে এত বেশি যে দুটোর কোনও তুলনাই হয় না। সে-সব আমি স্বপ্নে দেখেছি, তুমি বাস্তবে পাবে। আর আমি তোমার কাছ থেকে কী পাব, কী নেব সেটাও আমি ভালো করেই জানি।