আজ কুয়াশা কাটল ধীরে ধীরে। মোটরও এগিয়েছিল সাবধানে। শ্রীরামপুর পেরনোর পর শিপ্রা বলল, এরই কাছেপিঠে ডাইনে মোড় নিলে একটা পুকুর আছে। উঁচু পাড়িতে ছোট-বড় গাছ-গাছালি, রোদ্দুরটা পিঠ তাতালে সতরঞ্চি একটু সরিয়ে নিলেই হল। কিংবা বর্ধমান পেরিয়ে বাবার বন্ধুর বাগানবাড়ি। দশ বছর ধরে ফাঁকা। একটা মালী আছে মাত্র। কোনটা পছন্দ? আমার কোনও চয়েস নেই।
এই শীতের সকালে চলাটাই লাগছে বেশ, বসাটার চেয়ে।
যদিও ফ্লাস্কে বিস্তর চা-কফি ছিল তবু একটা পেট্রল স্টেশনের পাশে দরমার দোকানের বেঞ্চিতে দুজনাতে চা খেতে বসল।
কীর্তি দোকানিকে শুধাল, ব্যবসা-বাণিজ্য কীরকম চলছে?
অত্যন্ত সবিনয়ে বললে, আমাদের খদ্দের তো গরুর গাড়ি। এখন বাবুরা হুশ করে মোটরে চলে যান। রাস্ দাঁড়ালে সেও-বা কতক্ষণ। গরুর গাড়ি কমে যাচ্ছে। দোকানটাকে তাই খাড়া করতে পারছিনে।
শুকনো দরদ শোনাবার মতো এদের দুজনার কেউ নয়।
কীর্তি বললে, এটা বাঙলা দেশ, আবার ঢাকা-সিলেটও বাংলাদেশ। কিন্তু আমার মনে হয় বাস, মোটর বোধহয় বাঙলা দেশের নৌকোকে এতখানি ঘায়েল করতে পারেনি। তুমি কখনও বাঙলাদেশে গেছ?
হেসে বললে, খাঁটি বাঙালদেশের মাটিতে কখনও পা ফেলিনি কিন্তু বাংলাদেশে গিয়েছি। কোন এক স্টিমার কোম্পানির কী যেন এক পরবে কলকাতা থেকে সেঁদরবন হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট না কী যেন। কী সুন্দর দেশ, কী বলব। পরে আরও বলব, এখন চল।
মোটর চালাতে চালাতে কিন্তু শিপ্রা বলে যেতে লাগল প্যারিসের গল্প। কথায় কথায় শুধাল, তুমিও তো প্যারিসে ছিলে?
আমি একটা অপদার্থ। মোকামে পৌঁছাই। সব বলব।
.
০৭.
বাগানবাড়িটি শৌখিন নয় বটে কিন্তু মালীটাও আলসে নয়।
বাড়িটার প্রধান লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তার তিন দিকের প্রান্তর পরিমাণ বারান্দাগুলো। বাগান, রাস্তা পেরিয়েই কাটা ধানে খোঁচা খোঁচা শূন্য ক্ষেত। দিগন্তে গ্রামের সবুজ আভা। মালী প্রাচীন দিনের, অধুনা লুপ্তপ্রায় আরামদায়ক দু খানা ডেক-চেয়ার পেতে দিয়েছে। মোটর থেকে বের করে সতরঞ্চি-কুশনও।
শিপ্রা বললে, রবীন্দ্রনাথের গানে আছে, সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা, আর তোমাদের গানে আছে, দুপুরবেলার পিজি গো সন্ধেবেলার উ-ই-স্কি। কী খাবে বল।
বিলিতি পিনক জিন এদেশের বেয়ারা-বুলিতে পিনজিন। ছোট্ট গেলাসে প্রথমে কয়েক ফোঁটা বিটারস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গেলাসে জি ঢালা হয়। এটাকে জিন অ্যান্ড বিটাও বলেন কেউ কেউ। তবে এদেশে, বিশেষ করে গরমের দিনে, জিনের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা পাতিলেবুর রস দিয়ে গিমলেটটাই পছন্দ করেন স্মার্ট সেটের অধিকাংশ মেম্বার।
কীর্তি সঙ্গে সঙ্গে বললে, না, আমি সাদা চোখে কথা কইব।
শিপ্রা আতঙ্কের ভান করে বললে, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন গো? তুমি কি জর্মন আর আমি ফ্রান্স যে যুদ্ধশেষে সন্ধির শর্ত নিয়ে দরকষাকষি করতে এসেছি?
প্রথমটায় সামান্য একটু হকচকিয়ে কীর্তি হেসে বলল, ধরো তাই। কিন্তু আমার কোনওই শর্ত নেই। এতটা কাল আমি তোমার ভিতরের গণ্ডিতে ছিলুম না। তবু জানতুম, তুমি যে ধরনের মানুষ আমি কিছু চাইলে এ ধরনের লোক না বলতে পারে না। তবে এখন, আমি বলছি এখন, তোমার কাছে আমি কোনও কিছু চাইব কেন? যদিও আমি আমার সর্বাঙ্গে গৌরবের কাঁথা জড়িয়ে তোমার কাছে ভিখিরির মতো দু হাত একজোড় করে এককণা খুদের তরে উচ্চকণ্ঠে আবেদন আর দাবি দুই-ই জানাতে পারি।
শিপ্রা বললে, আমি যখন নিজের থেকে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তোমার বুকের কাছে এসেছি তার সরল অর্থ, এবং আমার অধিকার তুমি আমাকে তোমার ডানার ভিতরে খুঁজে নিয়ে সর্ব বিপদ সর্ব আঘাত থেকে রক্ষা করবে। যেখানে কনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও কথাই ওঠে না, সেখানেও পিতা যখন সম্প্রদান করে তখনও তো বর জানে তার ঘাড়ে কী দায়িত্ব চাপানো হল। আর
বাধা দিয়ে অবিমিশ্র সরল এবং অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে কীর্তি বললে, অপদার্থ। আমি যে কত বড় অপদার্থ সেইটে আমি জানি এবং সেটা তুমি আমাকে আজ এখানে না আনলে আজ দুপুরে তোমার বাড়িতে গিয়ে সেইটে ভালো করে বুঝিয়ে আসতুম। আমার মাত্র ওই একটি বক্তব্য আছে : সেটা আমি অপদার্থ।
তথ্যটা যাতে করে শিপ্রার চৈতন্যে গভীর দাগ কাটে তাই কীর্তি অপদার্থ শব্দটার ওপর পুরো জোর দিয়ে চুপ করে রইল।
তত্ত্বটা সত্য হোক মিথ্যে হোক, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কীর্তিকে যারাই চিনত তারাই জানত, ওর ভিতরে রত্তিভর ভড়ং নেই এবং সে যে অপদার্থ সেটা তার সরল, স্বাভাবিক অকৃত্রিম বিশ্বাস।
পক্ষান্তরে স্মার্ট, নন্-স্মার্ট সব চক্রই আপন আপন অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসন্দেহে সোৎসাহে হলপ নিতে এগিয়ে আসত যে শিপ্রার মতো স্থির বুদ্ধিধারিণী কন্যার মাথায় হাত বুলোতে পারে এহেন ধুরন্ধর মহানগরীতে বিরল–সর্বসমক্ষে বুলোয় একমাত্র তার চাকর বেয়ারা ঝি আয়া।
তা হলে প্রশ্ন, জেনে-বুঝে এই শিপ্রা অপদার্থ কীর্তিকে তার পার্টি রাউন্ডে ইনকাম ট্যাক্স্ অফিসারের সঙ্গে বচসা করার জন্য অবশ্য ব্রিফিংটা পুরোপুরি শিপ্রারই পাঠায় কেন? অবশ্য সেটা যে খুব একটা চোখে ঠেকত তা নয়। আর পাঁচজনকেও সে এ-কাজ ও-কাজের ভার দিত। তারাও সানন্দে কর্ম সমাপন করে দিত। তার কারণটাও জলের মতো পরিষ্কার। এই জটিল কলকাতার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক করপরেশনিক যুক্তফ্রন্টিক গোলকধাঁধার ভিতরে-বাইরে বহুজনকে নিত্য নিত্য এমনসব ব্যক্তিগত লজ্জাবতী-লতার মতো সাতিশয় ডেলিকেট সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয় স্থলে বুদ্ধিমতী যে রমণী তার মৃদুহাস্য, তার দরদিয়া অনুরোধ, তার মোহনিয়া ছল-কাতরতা দিয়ে গ্রন্থিমোচন করে দিতে পারে অধিকাংশ সমস্যাঁতেই।