.
যাত্রারম্ভের শেষ ফিনিশিং টাচ সমাপন করে শিপ্রা শুধাল, তুমি চালাবে? ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে।
আঁতকে উঠে কীর্তিনাশ বললে, সর্বনাশ! তবেই হয়েছে। তোমাকে কেউ বলেনি আমি নিজে যখন গাড়ি চালাই তখন সেটাতে মড়া লাশকেও লিট দিতে রাজি হইনে। করব অ্যাকসিডেন্ট, পুলিশ বলবে তারই ফলে লোকটা মারা গেছে।
স্টিয়ারিঙে বসে শিপ্রা বলল, ফাজলামো রাখো। সোভানি মোটরের জউরি। তার মুখে নিদেন একশোবার শুনেছি তোমার মতো মোটর মেরামতির হুনুরি এদেশে তো নেই-ই, জর্মনিতেও মেলা ভার।
কে বলেছে? সোভানি? তা তো বলবেই। আহা, কালকের পার্টিতে যদি দেখতে তার নৃত্যকলা। তুমি তখন লনের অন্য কোণে, কোন এক কন্সাল না কী যেন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মোলায়েম করছিল। এদিকে সোভানি তার ইয়া আড়াইমণি লাশটাকে লনের উপর বিন ঠেকনা দাঁড় করাতে পারছেন না, ওদিকে সে অন্ধ্রের ফিল্ম স্টার গোলাবাম্মাকে ভরতনাট্যমের কী একটা দারুণ জিগজাগ স্টেপ দেখাবেই দেখাবে। দু পাত্তর টেনেই মগজটি গোবলেট। ভরতনৃত্য সশরীরে দেখাতে গিয়ে দু হাতের চেটো উল্টো করে কোমরে রাখল লখনৌয়ের বাইজি স্টাইলে। তার পর সে হাতির পায়ের সাইজের এক-একখানা থাবা দিয়ে দেখাতে লাগল হরেকরকম মুদ্রা। কী একটা গানও ধরেছিল বুঝি বাজত ঘুঙুরিয়া না কী যেন। শেষটায় জড়ানো গলায় গোলাবাম্মার দিকে সাতিশয় বিনয় লাজুক নয়নে তাকিয়ে বলল, আপনার মতো গুনিনকে বুঝিয়ে বলতে হবে না– সেটা হবে কেরিইং কোল টু এ বার্ড ইন দি হ্যান্ড এ নৃত্যটার মূল বক্তব্য হচ্ছে তন্বঙ্গী শ্রীরাধা রসরাজ কেষ্টঠাকুরকে তাঁর পূর্বরাগ নিবেদন করছেন।
শিপ্রা খুশি হয়ে বললে, পার্টিটা তো তা হলে দারুণ সাকসেসফুল হয়েছিল। আর কী দেখলে?
সেটা ঘটেনি তাই দেখেছি বলি কী প্রকারে?
যথা–
বাসন্তী আর সুশান্ত তো চিরন্তনী মানিকজোড়। পার্টি-পরবের কথা বাদ দাও, তারা হাঁচেন একসঙ্গে, কাশেন এক সুরে। কাল দুজনা বসেছিলেন পার্টি নদীর দু পারে– চখাচখীর মিলন হয় না, জানো তো। এ তারও বাড়া। যেন চিরবিরহের সতীদাহে দু পারে দুজন দগ্ধ হবেন! মাঝে মাঝে আবার একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাপস। তখন চোখ থেকে আগুনের যা হল্কা বেরুচ্ছিল, আমি তো ভয়ে মরি, তোমার সাধের বাড়িটাতে আগুন লেগে যায়।
আরও বিস্তর দেখবার ছিল, শোনবারও ছিল। হ্যাঁ, পুব বাঙলার পলিটিকস্ নিয়ে দেখলুম দু একজন চিন্তিত।
শিপ্রা বলল, তুমি তো খবরের কাগজের হেডলাইনগুলোও পড় না, সে আমি জানি। আর আমি পড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ব্যাপারটা সত্যি বড্ড খারাপ মোড় নিচ্ছে।
কীর্তি বুঝল, শিপ্রা পুব বাঙলার পলিটিটা খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। তাই অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুধাল, আমাদের কি বিশেষ গন্তব্যস্থল আছে?
শিপ্রা বলল, রসো, গঙ্গা পেরোই। তার পর তুমি স্থির করবে। বোলপুর যাবে? শান্তিনিকেতন?
কীর্তি বলল, বোলপুর হ্যাঁ। তার পর ঈষৎ কাতর কণ্ঠে বলল, শান্তিনিকেতনে যেতে কিন্তু আমার সঙ্কোচ বোধ হয়, এমনকি ভয় করে।
শিপ্রা আশ্চর্য হয়ে শুধাল, কেন?
ওখানে সঙ্গীত নৃত্য এসব তো আছেই তার ওপর সেখানে হয় নানাপ্রকারের বিস্তর রিসার্চ। এসব তো আমি জানিনে, বুঝিনে। কারও না কারও সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। তখন তিনি যদি কোনও প্রশ্ন শুধান বা আলোচনা পাড়েন তখন আমি মুখ খুললেই তো চিত্তির। আবার একদম চুপ করে থাকাটাও অভদ্রতা।
এ তোমার বাড়াবাড়ি, আমি ভালো করে জানি, তুমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বহু বৎসর ধরে মন দিয়ে পড়ছ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালেকশন তোমার যা আছে সেটা রীতিমতো বিরল।
কীর্তি করুণতর কণ্ঠে বললে, ভাই, সে আমার নিতান্ত আপন আনন্দ। কিন্তু আটঘাট বেঁধে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় ওই দিয়ে কিছু বলতে যাওয়া তো সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া।
শিপ্রা বাঁ হাত দিয়ে কীর্তির উরু চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, থাক না তা হলে আশ্রমদর্শন। এগোই তো উপস্থিত পশ্চিম দিকে। তার পর দেখা যাবে।
কীর্তি বললে, তুমি আমাকে ভুল বুঝলে আমার দুঃখের অবধি থাকবে না। যাকে বলে রবীন্দ্রদর্শন তার সঙ্গে আমার পরিচয় অতিশয় নগণ্য। তবু আমার একটা অন্ধবিশ্বাস– বরঞ্চ বললে ভালো হয় আমার ইনসটিকটু বলে রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ এই দুটি লোক যা করে গেছেন সেটা পরিপূর্ণভাবে আপন বুকের রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে, ওই দিয়ে মগজের সেলগুলোর গঠন পালটে নিতে আমাদের আরও একশো বছর লাগবে।
শিপ্রা বলল, জর্মনরাও বলে গ্যোটেকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে তাদের আরও একশো বছর লাগবে। একাধিক চিন্তাশীল লোক বলেছেন, গ্যোটের নির্দেশ যদি সত্যিই আমরা আমাদের চিন্তাধারায়, আদর্শ নির্মাণে মেনে নিয়ে থাকতুম তা হলে হিটলারের আবির্ভাব হত না।
শীতকালে পশ্চিম বাঙলার বিশেষ করে বর্ধমান বীরভূম অঞ্চলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি থাকে না। তবে লক্ষ করলে প্রকৃতির একটা দিক মাঝে মাঝে বড়ই চমক লাগায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। শার্সি দিয়ে তাকিয়ে ঠাহর করা গেল না দেবতা আকাশে উদয় হয়েছেন কি না। তার পর হঠাৎ এক ঝটকায় সব দুনিয়া সাফ, আসমান জমিন এমনকি হাওয়াটাও যেন আলোয় আলোময় হয়ে গেল। রাজা অনেক আগেই আকাশের বেশ উঁচু জায়গায় সিংহাসনে আসন নিয়ে বসেছিলেন। সামনে ছিল যবনিকা। লগ্নকাল প্রত্যাসন্ন হওয়ামাত্রই রাজাদেশে দ্বারী চক্ষের পলকে সে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছে।