এবারে নৌকোর বারোয়ারি ডাবাহুকোতে এনরা গুড়ুক খেলেই হয়েছে আর কি!
মাঝি-মাল্লারা কিন্তু একটা বিষয়ে নিজেদের ভিতর বিস্তর আলোচনা করল। সায়েব-মেম একে অন্যের সঙ্গে অত কম কথা কয় কেন? ভাগ্যিস ওরা জানত না যে বিয়ের আগে ও-রেলি সায়েবের বাঁচাল বলে একটুখানি বদনাম ছিল বটে।
ভাওয়ালির হালদার বুড়ো মাঝি তালেবুদ্দি বললে, খুদাতালা কত কেরামতিই দেখালে; গোরা হ’ল রাজার জাত–আমাদের ডাঙর জমিদারের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারলে উনি সেটা আল্লার মেহেরবানি সমঝে দিলখুশ হয়ে হাবেলী চলে যান। আর সেই গোরা দেখো, মেমের রুমালখানা হাত থেকে পড়ে গেলে তখ্খুনি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে মেমকে এগিয়ে দেয়। আমি তো এ মামলা বিলকুল বুঝতে পারলাম না।
শুকুরুল্লা বললে, কইছো ঠিকই কিন্তু আমাগো সায়েব তো কখনো কাউরে চড় মারেনি। বল্কে, আমার মনে লয়, সায়েবরা হামেশাই কথা কয় কম, কাম করে বিস্তর। দেখছো না, যারা হাম্বাই-তাম্বাই করে বেশী, তারাই কাম করে কম।
মশলা-পেষা বললে, বউয়ের লগে যদি দুই-চারটা মিডা মিডা কথা না কইলা তয় বিয়া করলা ক্যান!
একই বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের মাঝি-মাল্লা চাষাভূষা অনেকক্ষণ ধরে তর্ক বিতর্ক করতে পারে না অবশ্য পুববাঙলার পটভূমি নিয়ে লেখা নভেলে তারা গোরা এবং বিনয়ের’ মত ঘণ্টার পর ঘণ্টা নব্যন্যায়ের তৈলধার জ্বলিয়ে রাখতে পারে। তারা আপন আপন রায় জাহির করেই চুপ করে যায়। তর্ক করে যুক্তি দেখিয়ে একে অন্যের অভিমত বদলাবার চেষ্টা করে না। তাই বোধ করি দ্ৰসমাজে নিছক অবাস্তব তর্কাতর্কির ফলে যে রকম মন কষাকষি এবং মুখ দেখাদেখি করা হয়, চাষা-ভূযোদের ভিতর সে রকম হয় না।
তাই আলোচনার মোড় বদলে গিয়ে সভাস্থলে প্রশ্ন উত্থাপিত হল, সায়েব-মেমরা সাঁতার কাটতে ভালোবাসে, কিন্তু নদীর জল ঘোলা হলে গোসল করে না কেন?
পুব-বাঙলার লোক জানে না, সায়েবদের কাছে সাঁতার কাটা হচ্ছে স্পোর্টস-বিশেষ–স্নানের খাতিরে তারা সাঁতার কাটতে নাবে না। আমাদের কাছে স্মান যা, সাঁতার কাটাও তা।
টূর থেকে ফিরে এসে ও-রেলি পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে একা কলকাতায় চলে গেল। সোম কিন্তু সবাইকে বললে, হুজুর সরকারি কাজে কলকাতায় গেছেন জানেন তো আজকাল যা স্বদেশী-ফদেশী আরম্ভ হয়েছে।
রায়বাহাদুর বললেন, দুদিকেই বিপদ দেখতে পাচ্ছি। সায়েব যদি স্বদেশীর পিছনে লাগে, তবে তাদের দফারফা। নেটিভদের সঙ্গে দোস্তি জমিয়ে ও তাদের সব হাড়হ শিখে নিয়েছে, কড়ি চালালে আর কারো রক্ষে নেই। ওদিকে ছোকরা আবার আইরিশম্যান, ওর আপন দেশে ইংরেজের বিরুদ্ধে চলেছে জোর স্বদেশী। ও যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে, তবে তার প্রমোশনেরও তেরোটা বেজে যাবে। চাই কি কমপলসরি রেটায়ারমেন্টও হতে পারে। থাক, ও-সব কথা কইতে নেই।
জুনিয়ার তালেবুর রহমান বললে, নৌকো দিয়েছেন ভাসিয়ে মাঝগাঙে আর তারপর করেছেন নোঙরের খোঁজ। সোমের সামনে খুলে দিয়ে দিয়েছেন শুঁটকির হুঁড়ি, আর এখন বলছেন, নাক বন্ধ কর।
রায়বাহাদুর বললেন, বাবা, সুধাংশু—
সোম জিভ কেটে, দুকানে হাত দিয়ে বললে, রাম, রাম।
এবারে ও-রেলি যখন কলকাতা থেকে ফিরল,তখন সকলেরই চোখে পড়ল তার মুখের উপর পাম্ভীর্যের ছাপ।
সায়েবরা কলকাতা থেকে ফিরলে, তা সে রাত বারোটাই হোক, তখখুনি যায় ক্লাবে, সবাইকে কলকাতার তাজা খবর বিলিয়ে তাক লাগিয়ে দেবার জন্য শ্বশুরবারি থেকে বাপের বাড়ি এলে মেয়ে যে রকম ধুলো-পায় সইয়ের বাড়িতে ছুট লাগায়। ক্লাবের সবচেয়ে নীরস বেরসিকও তখন কয়েকদিন ধরে আরব্য উপন্যাসের শেহেরজাদীর কদর পায়।
ও-রেলি ক্লাবে গেল ফিরে আসার তিনদিন পরে।
বুড়ো পাদ্রীর চোখের জ্যোতি কম। তার উপর এতখানি সাংসারিক বুদ্ধি নেই যে, কারো চেহারা খারাপ দেখালে তদ্দশ্যেই সে সম্বন্ধে প্রশ্ন শুধাতে নেই। ও-রেলিকে দেখামাত্রই শুধালেন, সে কি হে ডেভিড, তোমার চেহারা ও-রকম শুকিয়ে গেছে কেন?
মাদামপুরের বুড়া-সাহেব ঝানু লোক। ও-রেলি আমতা আমতা করছে দেখে বললেন, অসুখ-বিসুখ করেছিল হয়তো। কলকাতা বড় নাসটি প্লেডিসেন্ট্রি আর ডিসেন্ট্রি। কেন যে মানুষ কলকাতা যায় বুঝতে পারিনে। আমি যখন প্রথম মাদামপুর আসি
বিষ্ণুছড়া বাগিচার মেম বললেন, তা মিস্টার ও-রেলি, কলকাতার নুতন খবর কী?
মাদামপুরের বড় সায়েব তখন আশা ছাড়েননি; বললেন, কলকাতায় যেতে আঠারো দিন লাগত, আর
বিষ্ণুছড়া বাগিচার বড় মেমে আর মীরপুর বাগিচার ছোট মেমে যেন সাপে-নেউলে। একে অন্যের দেখা হলেই টুকাটুকি ঠোকাঠুকি। বললেন, মিস্টার ও-রেলি, কলকাতার সব খবরই নুতন। ফার্পোতে নেটিভরা ঢুকতে পারছে, সে-ও নূতন খবর। ময়দানে ঘাস গজাচ্ছে, সেও নূতন খবর।
বিষ্ণুছড়ার মেম ছোবল মারতেন, কিন্তু তার সায়েব শান্তভাবে মেমের হাতের উপর হাত রেখে চেপে দিয়ে বললেন, তাজা-বাসি আমরাই যাচাই করে নেব ও-রেলি। ওসব ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না।
আগে হলে ও-রেলি এতক্ষন সুবোধ ছেলের মত টু বী সীন নট টু বী হার্ড হয়ে বসে থাকতে না ততক্ষণ হয়তো প্রমাণ করে দিত। গড়ের মাঠে সত্যই কত রকম নূতন ঘাস গজাচ্ছে, তার রঙ গোলাপি, ফুল সবুজ আর সে ঘাস নেটিভ মাঠে পা ফেললেই গোখরোর মত ছোবল মারে–ডেঞ্জারেস পয়জকিবা হয়তো গম্ভীরস্বরে বয়ান করত, নেটিভরা এখনো ফার্পোতে ঢুকতে পায়নি, তবে কি না এ খবরে কিছুটা সত্য এখন ফার্পোর টেবিল-চেয়ার সরিয়ে সেখানে কার্পেটের উপর গোবর নিকনো লেপানো হয়েছে, আর তারই উপর সায়েবরা থাল পেতে হাপুর-হপুর শব্দ করে খিচুড়ির সঙ্গে মালেগাটানি সুপ মাখিয়ে খাচ্ছেন।