ও-রোলি বসে রইল বুড়ো পাদ্রী সায়েবের সঙ্গে বটগাছতলায় পিকনিকের হেড আপিসে। অবশ্য বউ মেব্ল্ও তার গা ঘেষে।
বুড়ো পদ্ৰী গল্প বলে যেতে লাগলেন, চল্লিশ বছরের আগেকার কথা। এসব গল্প মধুগঞ্জ বহুবার শুনেছে, কিন্তু ও-রেলির কাছে নুতন।
বুঝলে ডেভিড, তখন আমি ছোকরা পাদ্রী হয়ে এদেশে এসেছি। সোম এসব জানে, তার বাপ তখন এখানে সাবরেজিষ্ট্রর। আমাকে অনেক করে বোঝালে টিলাতে বাংলো না বানিয়ে যেন নদীপাড়ে আসন পাতি। তখনকার দিনে দুপুরবেলায় এখানে বাঘ চরাচরি করত, আমার একটা বাছুর চিতে নিয়ে গেল আমার চোখের সামনে, ব্রকফাস্টের সময়।
ও-রেলি শুধালে, টিলার মোহটা কী? আপনি তো হরিণ কিবা পাখী শিকারও করেন না।
পাদ্রী বললেন, বাঘ আর ম্যালেরিয়ার ভিতর আমি বাঘই পছন্দ করি বেশী। টিলার উপর ম্যালেরিয়া হয় কম। বন্দুক দিয়ে বাঘ শিকার করা যায়, কিন্তু মশা মারা কঠিন। কী বলো, সোম, তুমি তো রবার হলেই বন্দুক নিয়ে মত্ত। কত বার বলেছি, সোম, বরবার স্যাবিধ-শাস্তির দিন। এদিনটায় রক্তারক্তি নাই করলে।
সোম বললে, স্যার, তেত্রিশ কোটি দেবতা ছেড়ে একজন দেবতা পেয়ে আমার লাভ না ক্ষতি? তারপর ও-রেলির দিকে তাকিয়ে শুধাল, আপনি-ই বলুন, চীফ, তেত্রিশ কোটি টাকার মাইনে ছেড়ে দিয়ে এক টাকার চাকরি নেয় কোন্ লোক?
পাদ্রী বললেন, ওর যে সব কটা মেকি।
সোম বলেলেন, আমি পুলিসের লোক, স্যার, মেকি টাকা চিনতে না পারলে আমার সায়েবই কাল আমাকে ডিসমিস করবেন। মেকি খাঁটিতে তফাত আমি বেশ জানি। কিন্তু এদিককার তেত্রিশ কোটি আর ওদিককার একজন কেউ তো কখনো আমার থানায় এসে এজাহার দেননি। বাজিয়ে দেখব কী করে? মাঝে মাঝে সন্দ হয়, সব কজনই মেকি।
পাদ্রী বললেন, মাই বয়! কী বলছ?
পাদ্রীর বুড়ী বউ স্বামীকে বললেন, তোমাকে কতবার বলেছি, সোমের সঙ্গে কখনো ধর্ম নিয়ে আলোচনা কোরো না। ও যে শুধু হিন্দু তাই নয়–হিন্দুদের ভিতর অনেক সৎ লোক আছেন–ও একটা আস্ত ভণ্ড।
তারপর ও-রেলিকে শুধালেন, সোম আমাদের টিলায় এত ঘন ঘন আসে কেন?
রেলি হেসে পালটে শুধালেন, কেন, আপনাদের ঝগড়া মেটাতে?
বুড়ী রেগে বললেন, বিয়ে করেছ তো মাত্র সেদিন! ঝগড়ার তুমি কী জান হে, ছোকরা? সে কথা থাক; সোম আসে শুধুমাত্র মুগী খেতে, বাড়িতে পায় না বলে।
সোম বললে, মাশ্মি, আপনি সে ধরতে পেরেছেন, সে কথাটা এতদিন বলেননি কেন?
বুড়ী থ হয়ে বললেন, সে কী রে? তোকে এক শ বার বলেছি, তোর বাপকে পর্যন্ত লুকিয়ে রাখিনি।
সোম বললে, কই, আমার তো মনে পড়ছেনা? তা কাল থানাতে গিয়ে দেখব, কোনো পুরনো নথিতে রিপোর্ট লেখা আছে কি না?
বুড়ো পাদ্রী ও-রেলি আর মেবলের চোখের উপর কয়েকবার স্নেহের চোখ বুলিয়ে বললেন, এই যে ডেভিড সোম আসে আমাদের ঝগড়া মেটাতে, তা সে কিছু ভুল বলেনি। আজ যে রকম ডেভিড মেবল্বে নিয়ে এসেছে ঠিক তেমনি আমিও একদিন নিয়ে এসেছিলুম গ্রেসিকে। পনেরো বছর কেটে যাওয়ার পর একদিন আমাদের ভিতর সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়াতে হঠাৎ গ্রেসি বললে, তবে কি আমাদের হনিমুন আজ শেষ। সেই সেদিনই আমি সামলে নিলুম। তারপর দেখো, কেটে গেছে আমাদের হনিমুনেরা আরো পঁয়ত্রিশ বছর।
সোম বললে, সে কথা মধুগঞ্জের কে না জানে বলুন। কিন্তু আমার বেলা উল্টো। যাবজ্জীবন দীপান্তর মানে চোদ্দ বছরের জেল। আমার বেলা তারও বেশী। বিয়ে করেছি চোদ্দ বছর বয়সে, তারপর কেটে গেছে প্রায় আঠার বৎসর। এখনো কেউ খালাস করবার কথাটি তোলে না।
পাদ্রী সোমের পাগলামিতে কান না দিয়ে বললেন, ঠিক এই গাছতলাতেই বসেছিলুম শ্রেসিকে নিয়ে। বাঘ-ভালুকের ভয় না করে। পাশের ঝোপে কোকিল কুহু কুহু করছিল। আমাদের মনে কী আনন্দ! এমন সময় একটা হনুমান হুম হুম করে আমাদের সামনে দাঁত-মুখ খিঁচোতে লাগল। গ্রেসি কখনো বাদর দেখেনি। প্রায় ভিড়মি গিয়ে আমার কোলে মুখ গুঁজলো।
বুড়ী মেম লজ্জায় রাঙা হয়ে বললেন, ব্যস ব্যস হয়েছে। এর পরও ডেভিড মেব্ল্ উঠল না।
.
০৫.
দেখা যেত দুজনকে, রাস্তা থেকে, তাদের বাঙলোর বারান্দায় ছাতা ল্যাম্পের নীচে আরাম-চেয়ারে বসে আছে। কখনো সায়েব মেম-সায়েবের হাত-পাখাখানা এগিয়ে দিচ্ছে, কখনো মেম-সায়েব ঘরের ভিতর গিয়ে দুহাতে দুটো লাইমজুস নিয়ে আসছে। আর কখনো বা সিংহলী বাটলার জয়সু বারান্দার একপ্রান্তে গ্রামোফোন রেকর্ডের পর রেকর্ড বিলিতি বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই নির্জন বারান্দায়, কিংবা টিলার বাগানের লিচুগাছতলায় দুজন পাশাপাশি বসে সামনের কালাই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে।
জ্যাৎস্না রাতে দুজনা ডিনারের পর বারান্দা থেকে নেমে লিচু বাগানের ভিতর দিয়ে নেমে আসত সদর রাস্তায়। সেখান থেকে চলে যেত নদী-পারে। নদী-পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছত গিয়ে রামশ্রী গ্রামে, সেখানে ছোট্ট কিসাই নদী বড় নদী কাজলধারার সঙ্গে মিশেছে।
কিংবা তাদের মাথায় চাপত অদ্ভুত খেয়াল । কিসাই কাজলের মোহনায় খেয়াঘাট; তারা সেই রাত দশটায় হাট-ফর্তাদের সঙ্গে বসত খেয়া-নৌকায়–বাতার উপর। তারপর দুপুর রাত অবধি খেয়া-নৌকায় বসে এপার-ওপার করে বাড়ির পথ ধরত চাঁদ যখন
মেম আসার পর সায়েব টুরে গেছে মাত্র একবার। মেমকে সঙ্গে নিয়েই গেল। ভাওয়ালি নৌকায় করে দুদিনের রাস্তা। রোজ সন্ধ্যায় সায়েব-মেম ভাওয়ালির ছাদের উপর বসে বসে মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালি গান শোনে, আর কখনো বা জয়সূর্য অল্প ভলগা-মাঝির গান গ্রামোফোনে বাজায়। মাঝি-মাল্লারা সে গীত শুনে তাজ্জব মানে, আর মাঝে মাঝে তার নকল করতে গিয়ে মেম-সায়েবের কাছে ধমক খায়। মেম বলে ভাটিয়ালিই ভালো-মাঝিরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তাদের গান সায়েবদের কলে বাজানো গাওনার চেয়ে ভালো, এও কি কখনো সম্ভবে। তবে কি না সায়েব সুবোদের খেয়াল, আল্লায় মালুম, ওদের দিল ওদের দরদ কখন কোন দিকে ধাওয়া করে। একদিন তো মেমসায়েব নামের মশলা-পেষা ছোকরাটার বাঁশের বাঁশী চেয়ে নিয়ে সাবান দিয়ে ধুয়ে-পুছে ভাটিয়ালির সুর অনেকক্ষণ ধরে বাজালে।