এ ভুলটাও তিনি গোপন রাখেননি। সেদিক দিয়ে তিনি সত্যিই সরল প্রকৃতির লোক। মেমসায়েবের সঙ্গে তার ভেট তিনি সবিস্তর বাখানিয়া বললেন, চাপরাসী ইন্তাজ আলীকে যে তিনি দু আনা বখশিশ দিয়েছেন সেটাও বলতে ভুললেন না।
সবশেষে খানিকক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে বললেন, সায়েবের সঙ্গে তো আমার বিশেষ পরিচয় নেই, তবু কেমন যেন মনে হল একটু বদলে গিয়েছে। ঠিক বুঝতে পারলুম না।
আড্ডা বললেন, আপনিও তাজ্জব বাত বললেন, রায়বাহাদুর। বিয়ে করে কোন মানুষ বদলায় না, বলুন দিকিনি? অন্তত কিছু দিনের জন্য?
সোম উপস্থিত ছিল। কেউ কেউ লক্ষ্য করল সেও কোনো আপত্তি জানাল না।
রায়বাহাদুর বললেন, কী জানি ভাই, আমার অতশত স্মরণ নেই। বিয়ে করেছিলুম কবে, সেই ঠাকুদ্দার আমলে।
জুনিয়ার তালেবুর রহমান বললে, সে কি, স্যর। বিয়ের পূর্বের কেসগুলোও তো আপনার খুঁটিনাটি সুদ্ধ মনে আছে।
উকিল মেম্বাররা সায় দিলেন।
রায়বাহাদুর গুণী লোক। মুনিঋষিরা যে রকম এককালে এক্সরে দৃষ্টি দিয়ে হাঁড়ির খবর জানতে পারতেন তিনিও হয়তো খানিকটা আসল খবর ধরতে পরেছিলেন; তবে কি না ঋষিদের তিন হাজার বছরের পুরনো লেন্স অনাদর-অবহেলায় ক্ষয়ে ঘষে গিয়েছে বলে ছবিটা আবছা আবছা হয়ে ফুটল।
ও-রেলি তাগড়া জোয়ান, তার উপর পার্টি-পরবে ভোর অবধি বেদম নাচতে পারে একটা ডান্সও মিস না করে। তাই বিয়ের পর আড্ডাঘরের ‘গ্যালা’-নাচে সবাই আশা করেছিল ও-রেলি হয় বউকে কোমরে ধরে লাফ দিয়ে টেবিলের উপর তুলে নিয়ে নাচতে শুরু করবে কিংবা হলের মধ্যিখানে বউকে দুই ঠেঙে তুলে ধরে পই পই করে তার চতুর্দিকে সার্কেসি ঢঙে চক্কর খাওয়াবে। অন্ততপক্ষে টাঙ্গো নাচের সময় সে যে বউকে নিবিড় আলিঙ্গনে ধরে নিয়ে গভীর দোদুল দোলা জাগাবে সে আশা এবং বুড়ী মেমেরা সে আশঙ্কা–নিশ্চয়ই মনে মনে করেছিলেন। কারণ, বউকে, তাও আবার আনকোরা বউকে নিয়ে নাচের সময় যে ঢলাঢলি করা যায় সেটা ইংরেজ সমাজে পরকীয়াতে চলে না। ফ্রান্সে চলে, তবে নাচের মজলিসে নয়।
ও-রেলি নেচেছিল এবং তার নাচে প্রাণও ছিল, কিন্তু আয়ারল্যাণ্ডে নব বর এ রকম নাচের সময় যে কুরুক্ষেত্র জাগিয়ে তোলে এখানে সেটা হল না। কেউ কেউ কিঞ্চিৎ নিরাশ হল বটে, তবে ঝানুরা জানেন নববর (অর্থাৎ নওশাহ নূতন রাজা) পয়লা রাতে কী রকম আচরণ করবে তার ভবিষ্যদ্বাণী কেউ কখনো করতে পারে না। মদ খেলে বাঁচাল হয়ে যায় চুপ আর বোবা হয় মুখর–আর বিয়ে করা তো সব নেশার চেয়ে মোক্ষম নেশা, খোঁয়ারি ভাঙাতে গিয়েই বাদবাকী জীবনটা কেটে যায়। কিন্তু তাই বলে যে সব সময় ঠিক উলটোটাই ফলবে তারও তো কোনো স্থিরতা নেই। আবহাওয়ার জ্যোতিষীরা বললেন, বৃষ্টি হবে অতএব আপনি ছাতা না নিয়ে বেরলেন? ফলং?–ভিজে কাঁই হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ব্যত্যয়ও তো হয়।
কাজেই পালোয়ান এবং নাচিয়ে ও-রেলি আড্ডাঘরকে তার হক্কের পাকা সের থেকে এক ছটাক বঞ্চিত করাতে অল্প লোকই তাই নিয়ে মাথা চুলকালো!
গ্যালা নাচের পর পাদ্রী বাংলো দিলে পিকনিক। বাইরের বেশী লোককে নেমতন্ন করা হয় না, কিন্তু সোমের ডাক পড়েছিল কারণ পাদ্রীরা এ বাবদে বাঙালী, সায়েব কারোরই মত এত মারাত্মক নাকতোলা নয়। পাদ্রী-টিলার পিছনে যে ছোট ছোট টিলা আর বন বাদাড়ের আরম্ভ তার শেষ হয় কুড়ি মাইল দূরে রেলস্টেশনে পৌঁছে। এ বনে বুনো আম, কাঁঠাল, বৈঁইচি, কালো জাম, মিষ্টি, মধুর সন্ধ্যানে সকাল-সন্ধ্যে কাটিয়ে দেওয়া যায়। মৌসুমের সময় মাটিতে ফোটে অগুনতি লুটকি ফুল, আর গাছের গা ঝুলে ফুলে উঠে রঙ-বেরঙের অর্কিড (বাঁদরের ন্যাজ)। এ জায়গাটায় পিকনিক করতে গেলে তাস পাশা নিয়ে যেতে হয় না, গাছতলায় বসে দুটি খেয়ে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না,–এখানে একা একা কিংবা ছোট ছোট দল পাকিয়ে অনেক কিছুর অনুসন্ধানে বেরানো যায় আর লুকোচুরি খেলার অলিম্পিক যদি কোনোদিন তার সদর অপিস খুলতে চায় তবে গড়িমসি না করে এখানেই সোজা চলে আসবে।
পাদ্রী-টিলাতে আপোসে বিয়ে হলেই এখানে তার পরের দিন পিকনিক। পিকনিকওয়ালার আবার বর বধূকে নানা ছুতোয় একা একা এদিক ওদিক গুম হয়ে যেতে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে তাই নিয়ে চোখ ঠারাঠারি করে।
বর-বধু বিয়ের পর প্রথম কয়েক দিন একে অন্যকে চিনে নেয় ঘরের ভিতরে, বাইরে, বারান্দায়, নদীর পারে চাঁদের আলোতে কিংবা সমাজে আর পাঁচজনের ভিতর। এখানে নিভৃতে বনের ভিতর একে অন্যকে চিনে নেওয়ার ভিতর আরেক অভিনব মাধুর্য আছে-ওদিকে বন্ধুবান্ধব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নও তারা নয়। ডাক দিলেই সাড়া মিলবে ওরা তো এসেছে ওরা তো এসেছে নব বরের নূতন শাহের খেদমত করার জন্যই।
খোয়াইডাঙার দিগ্দিগন্ত-মুগ্ধ কবি, পদ্মার অবিচ্ছিন্ন অবিরল স্রোতের সঙ্গে যে কবি তার জীবন ধারার মিল দেখতে পেয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, গ্রহসুর্যে-তারায় বিশ্ব-স্রোত বিশ্ব-গতি হৃদয় দিয়ে আবিষ্কার করলেন, সে কবি পর্যন্ত আপন বঁধুয়ার যে ছবিটিকে বুকের ভিতর একে নিতে চেয়েছিলেন সেটি পত্র পল্লবের অর্ধ-অচ্ছাদনে, বনানীর মাঝখানে–
পাতার আড়াল হতে বিকালের
আলোটুকু এসে
আরো কিছুখন ধরে ঝলুক তোমার
কালো কেশে ৷
হাসিয়ে মধু উচ্চহাসে
অকারণ নির্মম উল্লাসে–
বনসরসীর তীরে ভীরু কাঠ-বিড়ালিরে
সহসা চকিত কোরো ত্রাসে।