সকাল বেলা জয়সুর্যকে ডেকে বললাম, তুমি মেদের জাহাজ ধরিয়ে দেবে। বোম্বাই, মাদ্রাজ কিংবা অন্য কোনো বন্দরে। সেটা পরে স্থির হবে। তারপর তুমি কিছুদিনের জন্য সেখান থেকে সোজা দেশে যেয়ো। আগে যখন ছুটি চেয়েছিলে, তখন সুবিধে হয়নি, এখন আমার একলার কাজ আরদালিই করতে পারবে।
জয়সুর্য খুশী না বেজার হল তার মুখ থেকে বোঝা গেল না।
আমি সেদিনই কুকটুক সব ট্রাভেল এজেন্সিকে চিঠি লিখে দিলুম, কবে কোন বন্দর থেকে কোন্ জাহাজ ছাড়বে, জায়গা পাওয়া যাবে কিনা, ভাড়া কত ইত্যাদি জানতে। ফলে যে সাত উই মালমশলা উপস্থিত হল, সে তো ঐ সময় তুমি একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেছ। আমার কেমন যেন আবছা আবছা মনে পড়ছে, সেদিন তোমার সঙ্গে একটু খিটখিটে ব্যবহার করেছিলুম। তার কারণ যদিও তখন আমি ঐসব কাগজপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, কিন্তু তারই আড়ালে আমার অন্য প্ল্যানটাকে আমি ফিটফাট ওয়াটার-টাইট করে নিচ্ছিলুম।
বাইরের শোটাকে তার ফিনিশিং টাচ দেওয়ার জন্য আমার দরকার ছিল শুদ্ধ কয়েকখানা লাগেজ লেবেলের। কোনো কোনো ট্রাভেল এজেন্সি খদ্দেরকে আপন চালাকি দেখাবার জন্য কেবিন বুক হাওয়ার পূর্বেই কিছু লাগেজ টিকেট পাঠিয়ে দেয়। যেমন যেমন মেলের এক একটা সুটকেস, ও ট্রাঙ্ক তৈরী হতে লাগলো সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের উপর সেই লেবেলগুলো সেঁটে দিতে লাগলুম।
ওদের দিকটা তৈরী, এখন আমার দিকটা ঠিক করতে হবে।
মানুষ মারা তো অতি সহজ, বিশেষ করে যে মানুষ যখন তোমার অভিসন্ধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন। আসল সমস্যা মড়া নিয়ে। বেশীর ভাগ খুন ধরা পড়ে মড়া থেকে এবং খুনী ধরা পড়ে তার থেকে।
ক্রমে ক্রমে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাক্স-প্যাটরা তৈরী, রাস্তার জন্য অস্পস্বল্প খাবার দাবারও প্যাক করা হয়েছে। পরদিন ভোরবেলা আমি মেদের মোটরে প্রায় কুড়ি মাইল দূরের রেল স্টেশনে পৌঁছে দেব।
সন্ধ্যের সময় চাকরবাকরদের ছুটি দিলুম। তারা যেন ভোরবেলা এসে মালপত্র মোটরে তুলে দেওয়াতে সাহায্য করে।
ডিনারের খবর নিয়ে যখন জয়সূর্য এল, তখন আমি হঠাৎ মেকে বললুম, আজ এ ডিনারে জয়সূর্য আমাদের সঙ্গে বসে খানা খাক।
মেবল্ অবাক হয়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। তার চোখে আপত্তির চিহ্ন ছিল।
আমি বললুম, আফটার অল, ও তোমাদেরই একজন। অন্তত একদিনের জন্য তাকে তার ন্যায্য সম্মান দেখানো উচিত।
মেব্ল্ চুপ করে রইল।
খানা টেবিলে জয়সূর্যকে বসতে দেখে পেট্রিক খুশি।
আমি বললুম, বাটলার, তুমি সূপটা নিয়ে এসো; মে তুমি নিয়ে আসবে মাংস; আর আমি নিয়ে আসব পুডিং।
ব্যবস্থাটা সকলের মনঃপূত হল কি না তা ভাববার ফুরসত নেই। আমাকে আমার প্ল্যান-মাফিক কাজ করে যেতে হবে।
সে এক অদ্ভুদ ডিনার। সবাই চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে।
পুডিং আনার জন্য আমি গেলুম রান্নাঘরে।
পকেটে আর্সেনিক ছিল। ডাক্তারি শাস্ত্রে যে পরিমাণের প্রায়োজনের কথা বলে তার চেয়ে একটু বেশি করেই জয়সুর্য মেবল্ আর পেট্রিকের পুডিঙে মিশিয়ে দিলুম।
ওদের ছটফটানি, মৃত্যু-যন্ত্রণা আমি দেখিনি। আমি ততক্ষণে বড় লিচুগাছটার কাছে গোর খুঁড়তে লেগে গিয়েছি। কাজ সহজ করার জন্য দুদিন আগে মালিকে দিয়ে সেখানে মৌসমী ফুল ফোঁটাবার ফ্লাওয়ার বেড খুঁড়িয়ে রেখেছিলুম। এক বস্তা চুনও আনিয়ে রেখেছিলুম।
রাত প্রায় চারটের সময় গোর শেষ হল।
তারপর লাগেজগুলো নিজে মোটরে তুললুম চাকরদের আসবার আগেই বেরিয়ে যাব বলে, তাদের বলেছিলুম ছটায় আসতে। স্টেশনে পথে দশ মাইল দূরে বড়শীছড়া নদীর উপর যেখানে পোল, তারই ডান দিক দিয়ে যে ছোট্ট রাস্তা তারই উপর দিয়ে মোটর চালিয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানে লাগেজগুলোর সঙ্গে ইট বেঁধে ডুবিয়ে দিলুম নদীর গভীরে।
তারপর বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়লুম।
আমাদের মহাকবি বলেছেন, ঘুম সঞ্জীবনী রসে প্রাণকে নবজীবন দান করে সে কথা আমি মানি। কিন্তু তার উল্টোটাও হয়, তুমি লক্ষ্য করেছ কি? নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে গেলে ভাবলে অন্তত ঘণ্টা দশেক গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকবে। আধঘণ্টা যেতে না যেতেই হঠাৎ পা দুটো হ্যাঁচকা টানে সটান খাড়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
শুনি আহির মনের অট্টহাসি। যে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এতদিন প্যানের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঠিক ঠিক নিখুঁত পরিপূর্ণ করে সমস্ত কর্ম সমাধান করলুম, ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি পায়ের তলার সে দৃঢ় ভূমি হঠাৎ ভলভলে কাদা হয়ে গিয়েছে আর আমি ক্রমাগত তলার দিকে ডুবে যাচ্ছি। ঘামে আমার সর্ব শরীর ভিজে গিয়েছে, আমি কলাপাতার মতো থরথর করে কাঁপছি। আমার শরীর, আমার মন আমার বাজার বাইরে চলে গিয়েছে। হঠাৎ হয়তো বা চিৎকার করে ফেলি, আমি খুন করেছি। লিচুগাছটার তলা খোড়ো, সবকটা মড়া সেখানে পাবে!
নিজের গলা সবলে হাতে চেপে ধরে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করি। দেখি, হাত ওঠে না।
এই হল আহির মনের সবচেয়ে বড় শয়তানি। তোমাকে আত্মপ্রত্যয় দেবে, সাহস দেবে, সব বাধাবিঘ্ন উত্তীর্ণ হবার হাজারো সন্ধি-সুড়তে দেবে, তারপর যে মুহূর্তে তার ইচ্ছামত কর্মটি সমাধান হয়ে গেল, অমনি তোমাকে তোমার বিভীষিকার হাতে সমর্পণ করে চলে যাবে।
আমি মর্মে মর্মে অনুভব করলুম, বিশ্বাসঘাতকতাকে সৰ্বদেশ সর্বশাস্ত্র কেন সবচেয়ে বড় পাপ বলে নিন্দে করেছে।