আপিসে কাগজপত্র সই করার সময় তারিখ দিতে হয়, বরের কাগজও মাঝে মাঝে পড়েছি, কাজেই দিন, মাস, বৎসর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন কখনো হতে পারিনি। তাই জানি এই করে করে বছর পাঁচেক কেটে গেল।
সত্যি বলছি, সোম বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার জীবনে এ পাঁচ বছরে কিছুই ঘটেনি। লড়াই লেগেছিল বলে প্রচুর খেটেছি, হাট লুট বন্ধ করে রেখেছি, স্বদেশী আন্দোলনকে ছড়াতে দিইনি। সাধারণ মানুষের চরিত্র গড়ে ওঠে, তার জীবন বিকাশ লাভ করে এই সব ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে, বাইরের ঘটনা তার মনকে গড়ে তোলে; অবার সেইমন তার ভবিষ্যৎ কর্মধারাকে নূতনভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। আমার জীবনের উপর বাইরের কোনো ঘটনা এ পাঁচ বছর কোনো দাগ কাটতে পারেনি।
আর ভিতরের জীবনের কিছুটা ইঙ্গিত তোমাকে দিয়েছি। আর ভিতরকার জট যদি আমি নিজেই ভালো করে ছড়াতে পারতাম তা হবে তোমাকে বলতুম–আমি পারিনি।
শুধু মেব্ল্ দূর হতে আরো দুরে চলে গেল। যে মেব্ল্ একদিন মার্সেলেসে দাঁড়িয়ে শভ রঙের রুমাল নেড়ে নেড়ে জাহাজে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, পাড়ে নেমে আমি রেখেছিলুম তার কাঁধে আমার হাত দুখানি, সে চেপে ধরেছিল আমার বাহু দুখানি সেই মেব্ল্ই হঠাৎ যেন আমাকে পাড়ে ফেলে উঠে পড়ল জাহাজে আর ধীরে ধীরে সে জাহাজে অদৃশ্য হলো অসীম নীলিমার অন্তহীন শূন্যতায়। কাতর আর্তনাদে, করুণ নিবেদনে আমি তাকে ডাকতে পর্যন্ত পারলুম না।
আর নেই মেবল্-ই এই বারাণ্ডাতেই বসে, আমার থেকে তিন হাত দূরে।
শুধু বুঝলাম, আমার জীবন থেকে এ দ্বন্দ্ব কখনো যাবে না। শান্তি আমি কখনো পাব না।
.
৫ই ডিসেম্বর
পেট্রিকের জ্বর হয়েছে। সিভিল সার্জন দেখে গিয়েছে। বলেছে ভয় নেই। মেব্ল্ পাংশু মুখে বারাণ্ডায় পাইচারি করছে। একবার হ্যাটটা মাথায় দিয়ে পাদ্রীটিলার দিকে রওয়ানা হল। বহুকাল হল সে বাড়ি থেকে আদপেই বেরোয়নি। কিন্তু গেল না। ফিরে এল। তারপর বারাণ্ডার রেলিঙয়ে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে ভাবল।
আমি তো অন্ধ নই। দেখলুম, মাতৃত্বের রসে মেবলের দেহখানির প্রতি অঙ্গটি কী অনুরূপ পরিপূর্ণতার সৌন্দর্য পেয়েছে। যেন এদেশের বর্ষার ভরা পুকুর।
অনেকক্ষণ পরে মে আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বললে, এদেশের আবহাওয়া পেট্রিকের সইছে না। তার পড়াশুনার ব্যবস্থাও এখানে ঠিকমত হবে না। আমরা বিলেত যাই। তুমিও সঙ্গে চলো না? তোমার তো অনেক ছুটি পাওনা আছে।
বহুকাল পরে মেব কথা বলল। . আমি বললুম, সেই ভালো। তবে আমি সঙ্গে আসতে পারব না। তোমরা ইংলণ্ডের কোথাও বাড়ি করে থাকো। আমি পরে সুযোগ পেলে যাব।
মেব্ল্ মাথা নেড়ে সায় দিলে। সে কখনো আমার কোনো ইচ্ছায় আপন অনিচ্ছা জানায়নি, নিজের ইচ্ছা তো প্রকাশ করতই না!
এ রকম ধারা কোনো একটা পরিবর্তন আমার জীবন প্যাটার্নে আসতে পারে সে কথা আমি কখনো ভেবে দেখিনি।
অথচ এতো কিছু খুদার-খামাখা আজগুবী সমাধান নয়। চার-পাঁচ বছরের লেখাপড়ার সুবিধের জন্যে আমার মতো দু-পয়সাওয়ালা লোকের পরিবার আকছারই তো বিলেত যাচ্ছে।
তবু আমি সমস্ত রাত বিছানায় পড়ে রইলুম অসাড়ের মতো।
শেষ রাত্রে একটু তন্দ্রা এসেছিল। আচমকা ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে।
দেখি সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। সব সমস্যার সমাধানই হয় ঘুমে, স্বপ্নে কিংবা অবচেতন মনে।
মাত্র যে তিনটি প্রাণীর সঙ্গে আমার জীবনের যোগসুত্র, বরঞ্চ বলি, যে তিনটি প্রাণী আর আমাকে নিয়ে আমার জীবন, তারাই আমার জীবনকে অসহ্য করে তুলেছে পলে পলে, প্রতি ক্ষণে তারা আমার আয়ু ক্ষীণ করে নিয়ে আসছে, তিন দিক থেকে তিন রাহু আমার জীবনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে। একদিন বিলুপ্ত করে দেবে। এই নিয়ে আমার সিদ্ধান্তের আরম্ভ। পরের সিদ্ধান্তগুলো এক এক করে এই :
দুরে চলে গিয়ে আমার উপর এদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে। এ সংসারে এরা বেঁচে থাকবে, না আমি বেঁচে রইব?
আমি।
এরা পাপী, মরা উচিত এদেরই। মেব্ল্ পাপী, জয়সূর্য পাপী আর পেট্রিক ওদের পাপ-জাত সন্তান। আমি নির্দোষ, আমি কোন পাপ করিনি। আমি কস্মিনকালওে কারো হকের ধন থেকে একটি কানাকড়িও কেরে নিইনি। এরাই দিয়েছে আমাকে ফাঁকি, এরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন আমাকে দেবে শুধু ফাঁকি।
এরা মরে গেলে আমি শান্তি পাব। আমার দ্বন্দ্বের সমাধান হবে।
খুন কী করে করা হয়, তার সব কটা পদ্ধতিই জানি আমরা। তুমি আমি অর্থাৎ পুলিশ। খুনীরা আপন আপন সঙ্কীর্ণ বুদ্ধি অনুযায়ী পন্থা বেছে নিয়ে করে খুন। সব খুনের ইতিহাস, বিশ্লেষণ জড়ো হয় থানায়। কোন পন্থার কী গলদ, সামান্য কী একটা ত্রুটি কিংবা বিচ্যুতি এড়ালে খুনী ধরা পড়ত না, এসব তত্ব আমাদের ভালো করে জানা। আমরা যদি নিখুঁত খুন না করতে পারি, তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেন কোনো ঢ্যাঙা লোকওঁ সে চাঁদ ধরবার আশা না করে।
এ তো চ্যালেঞ্জ নয়। এ তো অতি সোজা কাজ। কিন্তু অতি সরল কমও অবহেলার সঙ্গে করতে নেই।
আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। আমার মনের গুহার হ্যামলেট, কিকসট, জীকল হাইড, মজদা, মনু বাই মরে গিয়েছে। এখন যা-সব আমি করতে যাচ্ছি, সেসব ডেভিড ও-রেলির সম্পূর্ণ নিজস্ব।
নির্দ্বন্দ্ব চিত্তে যে রকম বন্যার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলুম, পেট্রিকের ব্যপ্তিস্ম পরব করার সময় আমি যে রকম স্থির নিশ্চয় হয়ে এগিয়েছিলাম, এবারে ঠিকই তাই।