কিন্তু কর্মফলের লোভ ত্যাগ করে যে মানুষ কাজ করে গেল, তাকে অর্থাৎ তার প্রিয়পাত্রকে বুঝি তোমাদের ভগবান বকশিশ দেন জারজ সন্তান।
.
১লা ডিসেম্বর
যতই ভাবি মনকে এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত হতে দেব না, মূল কথা সংক্ষেপে বলে ফেলব, ততই দেখি আস-কথা, পাশ-কথা সব কথাই মনের ভিতর থেকে বাইরের প্রকাশে এসে নিষ্কৃতি পেতে চায়। অথচ মনের গভীর গুহাতে যে সব ভূতের নৃত্য অহরহ চলেছে তাদের একটাকেও তো আমি ভালো করে ধরতে পারছিনে। অনে, সজ্ঞানে, সুষুপ্তিতে, স্বপ্নে এরাই গড়ে তুলছে আমার জীবন দর্শন-ভোট-আনসাউ উ তারই বুদ্বদ শুধু চেতন মনে ভিড় করে, আত্মপ্রকাশের জন্য।
সে মনের গুহায় আছে, কত প্রাণী,–হ্যামলেট, ডন কিকসট ডক্টর জীল, মিস্টার হাইড এবং তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে এদের নাচাচ্ছেন আহুর মজদা, আহির মন, হয়তো ছেলেবেলাকার আমার আরধ্য দেবী মা-মেরি তখনো আমাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন করে ফেলেননি–এখনো আমি মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি আমার ছেলেবেলাকার শহরের গির্জায় আমি হাঁটু গেড়ে উপাসনা করছি আর তিনি করুণ বয়ানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন; এ স্বপ্ন আমি বড় ডরাই।
কখনো দিনের পর দিন বারাণ্ডায় জড়ের মতো বসে রইতুম হ্যামলেট হয়ে, আর তাকে ডক্টর জীল কানে কানে বলত, এই ভালো, চুপ করে বসে থাকো। সংসারের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কী করতে পার তুমি? কোন কর্মের কী ফল, তা আগে ভাগে জানবে কী করে।’ ভুলে গেছ, অস্কার ওয়াইলডের সেই গল্পটা? প্রভু যীশু এক অন্ধের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । তার পর পথে যেতে একদিন দেখেন, এই লোকটা এক বারবনিতার দিকে লোলুপ নয়নে তাকিয়ে আছে। প্রভু বিরক্ত হয়ে তাকে শাসন করলেন। উত্তরে সে কাতরকণ্ঠে বললে, আমার দৃষ্টিশক্তি ছিল না, আপনি আমাকে দয়া করে সে শক্তি দিলেন। এখন আমি তা দিয়ে অন্য কী করতুম, বলুন। তাই দেখো কর্মের কী ফল তা স্বয়ং প্রভু যীশুই যখন জানেন না, তখন তুমি, কীটস্য কীট, তুমি জানবে কী করে? কিংবা স্মরণ করো সেই চীনের গল্পটা। এক জমিদারের ছেলে বনে শিকার করিতে গিয়ে পথ হারিয়ে গুম হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশী তার বাড়িতে এসে শোক প্রকাশ করে তাকে সান্তনা জানালে। জমিদার ছিলেন জ্ঞানী লোক, শুধু বললেন, এই যে খারাপ হল, জানলে কী করে? তার দিন দশেক পরে ছেলেটা বন থেকে ফিরে এল একটা চমৎকার বুনো ঘোড়া সঙ্গে করে। সবাই এসে সানন্দে অভিনন্দন জানালে। জমিদার বললেন, এ যে ভালো হল, জানলে কী করে? তার কিছুদিন পর ছেলেটা ঐ বুনো ঘোড়া থেকে পড়ে পা খানা ভেঙে ফেললাম। সবাই এসে শোক প্রকাশ করলে। জমিদার বললেন, এ যে খারাপ; হল, জানলে কী করে? তার কিছুদিন পর লাগল লড়াই, সম্রাটের লোক এসে ধরে নিয়ে গেল সব জোয়ানদের; ছেলেটার পা ভাঙা বলে তাকে যেতে হল না। সবাই এসে আনন্দ জানালে। জমিদার বললেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবেই দেখো, কিসে কী হয়, বলবে কে?
আর কখনো বা সেই মারমুখো ডন কিকসটকে আরো ওশকাতে লাগত তার পিছনে দাঁড়িয়ে মিস্টার হাইড। কী দেখছ, বসে বসে? তোমার লজ্জা-শরম নেই, অপমানবোধ নেই? তুমি কি একটা পাপোশ না আস্ত একটা ভেড়? আপ্তা-ঘর তোমাকে নিয়ে কী ঠাণ্ডাব্যঙ্গ করে তার খবর রাখ? ইস্তেক নেটিভ, কালা-আদমী খানসামা-গুলো? এদিকে চোরচোট্টার উপর কী রোয়াব! ওঃ যেন কলকাত্তার হাইকোর্টের বড় জজ সাহেব নেমে এসেছেন মধুগঞ্জের গুনাহ-হারামি খতম করবার জন্য আর ওদিকে নিজের ঘরের বউ যে চুরি হয়ে গেল তার জন্য কোনো গরমি নেই। সায়েবের গায়ে বুঝি মাছের রক্ত–তাও শিঙি মাছের না, একদম পুঁটি।’ বুঝলে হে, মহামান্যবরেষু, সিন্নোর ডন কিখোঠে, ব্যাটারা এই কথা কয় কত রঙে কত ঢঙে! আর তোমার বাটলারটা। তওবা, তওবা–তা তোমাকে বলে আর কী হবে? এইবার লেগে যাও, তোমার হোঃ, হোঃ, হোঃ, তোমার
ছেলের ব্যাপটিজমের ব্যবস্থা করাতে।
এই রকমই একদিন ডন কিকসট, বা আমি হঠাৎ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে করলুম বাচ্চার বাপ্তিস্মের প্রস্তাব, জয়সুয়কে গডফাদার বানিয়ে।
তোমার মনে থাকার কথা, কারণ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে তুমি।
কাকে অপমান করার জন্য এ প্রস্তাব আমি করেছিলুম? মেকে? নিজেকে? কী বলব? ডন কিকসট কি কোনো কিছু ভেবে-চিন্তে করে? তবু লেখক সেরভান্তেসের মানসপুত্র ডন কিকসট কখনো কারো কিছু অনিষ্ট করেনি। আমি ডন কিকসটের পিছনে ছিল যে মিস্টার হাইড।
গির্জেঘরের সে দৃশ্য তোমার মনে আছে। মাঝে মাঝে; আমার পর্যন্ত মনে হয়েছিল, কাজটা বোধ হয় ঠিক হলনা।
তখন মিস্টার হাইড ধমক দিয়ে বলেছে, ফের!
আর আহির মন বলেছে, জীতে রহো বেটা!
আমি যা-কিছু করেছি তার জন্য তোমার কাছ থেকে আমি কোনো করুণা ভিক্ষা করছিনে, কোনো সহানুভূতি চাইছি না, কিন্তু সোম, আমার ভিতর এই যে গোটা ছয় ভিন্ন প্রকারের প্রবৃত্তি অষ্টপ্রহর অনবরত লড়াই চালাত, আমাকে নির্মমভাবে এদিক-ওদিক টান-হ্যাঁচড়া করত–একটা মড়াকে যে রকম দশটা শকুন ভেঁড়াছেড়ি করে আমার জাগরণ বিষাক্ত করে রাখত, আমি ঘুমুতে গেলেই খার্টটা নাড়াতে থাকত, ঘুমিয়ে পড়লে দুঃস্বপ্নের মতো বুক চেপে বসত, জেগে উঠেই দেখতুম তারা সব লোলুপ নয়নে পহর গুনছে, কখন আমি জাগব, কেউ দেবে চোখ ঠোকরে, কেউ ফুটো করে দেবে তালুটা এরা আমাকে নিয়ে কী করেছিল সেইটে তুমি কিছুটা বুঝতে পারলেই আমি আমার জীবনের একদিকটার কথা আর তুলব না।