পাদ্রী বাঙলোর নয়মি, রুথ, ইভা, মেরি সব কটা সোমত্থ মেয়ে জাত-বেজাত ভুলে পাইকেরি দরে পড়ল ও-রেলির প্রেমে। সে হ্যাপা সামলাতে না পেরে ও-রেলিকে বাধ্য হয়ে প্রকাশ করতে হলে তার বিয়ে দেশে ঠিক হয়ে আছে, ছুটি পেলেই বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে।
ও-রেলি বুদ্ধিমান ছেলে। বিয়ের খবরটা সে ভেঙেছিল সোমের কাছে। সোম খবরটাকে বিয়ে বাড়িতে ফাটাবার বোমার মতই হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ আদর করার পর সেটি ফাটিয়ে দিলে হাটের মধ্যিখানে, কিন্তু তার থেকে বেরল টিয়ার গ্যাস। সে গ্যাস পৌঁছে গেল পাদ্রী-বাঙলোয় পোপের মৃত্যুসংবাদ ছড়াবার চেয়েও তেজে এবং চোখের জলের জোয়ার জাগাল নয়মি, রুথ, ইভার হৃদয় ছাপিয়ে।
হায়, এরা তো জানে না ও-রেলিকে আশা করা এদের পক্ষে বামন হয়ে চাঁদ ধরার আশা করার মত। কিংবা তাতেই বা কি, এবং এ উপমাটাও হয়ত তারা জানে যে সামান্য একটা খরগোশ যখন চাঁদের কোলে প্রতি সন্ধ্যের অশ্বিনী-ভরণীকে ঢিঢ দিয়ে বসতে পারে তখন এরাই বা এমন কি ফেলনা? বিশেষ করে নয়মি। ভারতীয় সৌন্দর্যের নুন নেমক আর ইংরেজের নিটোল স্বাস্থ্য নিয়ে গড়া এই তরুণী; এর সঙ্গে ফ্লাট করার জন্য পঁচিশটে বাগানের ইংরেজ ছোঁড়ারা ছোঁকছোঁক ঘুরঘুর করে তার চতুর্দিকে, যদিও সকলেরই জানা শেষ পর্যন্ত তারা বিয়ে করে নিয়ে আসবে বিলেত থেকে কতকগুলো খাটাশমুখো ওড মেড।
এ তত্ত্বটাও ও-রেলির জানা ছিলো বলে সে একদিন সোমকে দুঃখ করে বলেছিল, দেখো, সোম, আর যে যা-খুশি ভাবুক তুমি কিন্তু ভেবো না যে, আমি পাদ্রী-টিলার মেয়েদের নিচু বলে ধরে নিয়েছি। আমার বিয়ে ঠিক না থাকলে, আমি ওদেরই একজনকে বিয়ে করতুম। মেয়েগুলির বড় মিষ্টি স্বভাব।
সোম কানে আঙুল দিয়ে বললে, ও কথা বোল না সায়েব। জাত মানতে হয়।
ও-রেলি আশ্চর্য হয়ে বললে, ক্রিশ্চানের আবার জাত কি?
সোম বললে, জাতের আবার ক্রিশ্চান কি?
করে করে এক বছর কেটে গেল।
ও-রেলি ছুটি নিয়ে বিলেত থেকে বউ আনতে গেল।
.
০৪.
খাশপেয়ারা পোক যখন বিয়ে করে তখন তার একদল বন্ধু বউকে ভালোমন্দ বিচার না করে কাঁধে তুলে ধেই ধেই করে নাচে আবার আরেক দল তার দিকে তাকায় বড় বেশি আড় নয়নে। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হ’ল না। সোমকোম্পানি দিনের পর দিন মেমসায়েবকে ফুল পাঠাল, মিষ্টি পাঠাল, মেমের জলে শখ জেনে ছোঁড়ারা তাকে নিত্যি নিত্যি ডিঙি চড়াল, পাদ্রীর টিলায় ঘন ঘন চড়ই-ভাতে নেমতন্ন করল, ক্লাবে আর বাগিচা-বাগিচায় বেনকুয়েট ডিনার হ’ল; এ দলের খুশির অন্ত নেই।
অন্য দল বিস্তর যাচাই করার পর শুধু একটি কথা বললে, মেয়েটি ভালো, কিন্তু কেমন যেন মিশুক নয়।
কিন্তু তাদের সর্দার রায়বাহাদুর চক্রবর্তীই তাদের কানা করে দিলেন আর একটি মহামূল্যবান তত্ত্বকথা বলে বললেন, নেটিভদের সঙ্গে ধেই ধেই করা উভয় পক্ষের পক্ষেই অমঙ্গল। ওরা রাজার জাত, রাজত্ব করবে; আমরা প্রজার জাত, হুজুরদের মেনে চলব। এর ভিতর আবার দোস্তি-ইয়ার্কি কী রে বাবা? তোমরা ভেবেছ লিবার্টি পেলে তোমাদের নুতন কর্তারা তোমাদের কোলে বসিয়ে মণ্ডামেঠাই খায়াবেন? দেখে নিয়ো, আজ আমি যা বললুম।
তখনো স্বরাজের ছবি দিগদিগন্তেরও বহু পিছনে আণ্ডার ভিতরে বাচ্চার মত নিশ্চিন্দি মনে ঘুমুচ্ছেন। কাজেই রায়বাহাদুরের সঙ্গে এ বাবদে তর্ক করার উপায় ছিল না; এবং এ ধরনের মুরুবিও তখন সর্বত্রই বিস্তর মজলিস গুলজার করে এই রায়ই ঝাড়তেন। রায়বাহাদুর আবার বললেন, নেটিভ সায়েব যেন তেলে জলে। সাবধান! কিন্তু মধুগঞ্জ এ সাবধানবাণীতে কান দেবার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করল না।
রায়বাহাদুর অবশ্য মেমসায়েবকে সেলাম দিতে প্রথম দিনই কুঠিতে গিয়েছিলেন। মেমসায়েব তার গলকম্বল মানমনোহর দাড়ি দেখে একেবারে স্ট্রাক, থ! রায়বাহাদুর ভালো করেই জানতেন আজকের দিনের দাড়ি-গোঁফ কামোনো ছোঁড়ারা তার দাড়িতে উকুন অথবা ছারপোকা আছে কি না তাই নিয়ে ফিসফাস গুজগাজ করে, কিন্তু অন্তরে তার দৃঢ়তম বিশ্বাস ছিল যে, তার দাড়ি-গোঁফের কদর প্রকৃত রসিক-রসিকদের কাছে কিছুমাত্র নগণ্য নয়।
আদালতে বিস্তর সায়েবকে তিনি বহুবার বেকাবু করেছেন তার দুটি কারণ ও প্রথম, তাঁর আইনজ্ঞান এবং দ্বিতীয় তাঁর মনস্তত্ত্ববোধ। সায়েবের সাদা মুখ লাল, নীল, বেগুনী রঙের ভোল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চটপট সমঝে যেতেন সায়েব চটেছেন, খুশি হয়েছেন, হকচকিয়ে গিয়েছেন কিংবা আইনের অথই দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছেন।
প্রথম দর্শনেই তিনি বুঝে গেলেন, মেমসায়েব তাকে নেকনজরে দেখেছেন। তারই পুরা ফায়দা উঠিয়ে তিনি তাকে মেলা অভিনন্দন আর অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি যে তার সেবার জন্য সব সময়ই তৈরী সে কথা বললেন, তার স্বামী যে অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি সে কথাও উল্লেখ করলেন, এবং বলতে বলতে উৎসাহের তেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আদালত যে এদেশে শুভাগমন করেছেন বলেই তার মনে পড়ল, এ আদালত নয়। ঝুপ করে বসে পড়ে বললেন, সরি, ম্যাডাম, আই ফরগট!
মেম তো হেসেই লাল। রায়বাহাদুর ঘেমে কালো। শেষটায় মেম বললেন, ইটস ও রাইট, রে ব্যাভুর; থ্যাঙ্কুয়ু ভেরি মাচ ইনডীড।
রায়বাহাদুরের এ ভুল জীবনে এই প্রথম নয়। বুড়ো বয়সে সিনিয়ার ম্যাজিস্ট্রেটের প্রথম পুত্রসন্তান হওয়াতে তিনি তাকে অভিনন্দন জানিয়ে টিফিনের পূর্বে বারের পক্ষ থেকে বলেছিলেন, আদালতের পুত্রসন্তান হওয়াতে আমরা সকলেই বড় আনন্দিত হয়েছি।