আশ্চর্য, শহরে কোনো কুকীর্তি হলে আমরা যে কটা ভ্যাগাবণ্ড বকাটে ছোঁড়াকে সন্দেহ করে ধরে এনে তাদের ধরে চোটপাট লাগাতুম, তারাই দেখি সকলের পয়লা কোমর বেঁধে লেগে গেল উদ্ধারের কাজে। এক মুহূর্তেই কোথায় গেল তাদের তাস-পাশা, ইয়ার্কি খিস্তি । আর সবচেয়ে তাদোড় ঐ পরেশটা যে আমার বাগানের লিচু পর্যন্ত চুরি করেছে। রায়বাহাদুর কাশীবরকে পর্যন্ত যে আড়াল থেকে মুখ ভ্যাঙচায়–সে দেখি তার ইয়ারদের নিয়ে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে নদীর ওপরে। সেই বানের ভরা গাঙে। কত লোক বাচল তারা দিনের শেষে, সন্ধ্যার অন্ধকারে দেখি আর সবাই চলে গিয়েছে, সে একা ভেলার উপরে বসে নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। গায়ে ধুতির ভিজে খুঁট। আমার বয়সাতিটা অমি তার দিকে ছেড়ে দিতে সে সেটা লুফে নিয়ে আমার দিকে ফের ছুঁড়ে ফেরত দিলে। বত্রিশখানা দাঁত বের করে এ-কান ও-কান জুড়ো হা করলে এই হল আমাদের ‘থ্যাঙ্কস, নো’র বাঙলা অনুবাদ।
তুমি জান, সোম, বন্যার পর শহরে কোনো কুকর্মের জন্য ওদের সন্দেহ করলে, ডেকে শুধু বাপু, বাছা, করতুম দু-একবার জেনে শুনে ছেড়ে দিয়েছি। কড়া কথা বলতে প্রবৃত্তি হয়নি।
আহুর মজদা আর আমির মনে নিরন্তর এ কী দ্বন্দ্ব! আহির মনের যে চেলার জ্বালায় উদাস্ত সমস্ত পাড়া অতিষ্ঠ,সঙ্কটের সময় সে দেখি হঠাৎ আহুর মজদার ডাকে হা-জি-র বলে তৈরী, প্রাণটা খোলামকুচির মতো বন্যার জলে ডুবিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত।
তোমার বিশ্বাস, কোনো কোনো মানুষ পাপাত্ম-ক্রিমিনাল মাইণ্ড নিয়ে জন্মায়। শেষবারের মতো বলেছি, তা নয় সোম, এরা সব মিসূফিট। এরা শুধু সঙ্কটের মাঝখানে জীবসত্তার চৈতন্যবোধে বেঁচে থাকার আনন্দ (জোয়া দ্য ভিভর পায় বলে দৈনন্দিন জীবন এদের কাছে অসহ্য একঘেয়ে বলে মনে হয়। আমার দেশে এ রকম ছোঁড়ারা পল্টনে ঢুকে গিয়ে আপন জীবনের সার্থকতা পায়। তাই বাঙালী পল্টন খোলা মাত্রই আমি সর্বপ্রথম এদেরই ডেকে পাঠিয়েছিলুম। এরা যে সেখানে সুনাম করেছে। সে কথা তোমার অজানা নয়।
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম। সেই সর্বব্যাপী হাহাকারের ভিতর আমি কিন্তু একটি বড় মধুর দৃশ্য দেখেছি। আমার টিলা, পাদ্রী টিলার চতুর্দিকে যখন আশ্রয়য়ার্থীরা চালা, মাচাঙ বানাতে ব্যস্ত, ভিজে কঞ্চি বাঁশ দিয়ে আগুন জ্বালাতে গিয়ে মেয়েরা চোখের জলে নাকের-জলে, তখন দেখি বাচ্চারা মহোল্লাসে শেকসপিয়ারের প্রিমরোজ পথটু ইটানেল বনফায়ারের পিকনিক চড়ই-ভাত বনের ভিতর সফল করে তুলেছে। এদের একের অন্যে সঙ্গে দেখা হয় ইস্কুল ঘরে, কিংবা খেলার মাঠে তা-ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আজ যেন তারা সবাই এক বিরাট বাড়ির প্রকাণ্ড পরিবার। সে বাড়ির ছাদ আকাশ, দেয়াল টিলাগুলো, খেলনার জন্য দুনিয়ার গাছপালা টিপটিপা আর নাশতার জন্য পিষ্টি-বৈচিমন, আনারালি, কালোজাম, বুনো কাঁঠাল। আর সবচেয়ে বড় আনন্দ, বাপ-মা শাসন করে না, তারা আশ্রয় নির্মাণে মত্ত। এরা যত বাইরে বাইরে কাটায়, ততই মঙ্গল। এই হনুমানদের জ্বালায় টিলার হনুমানগুলো তখন বাপ-বাপ করে এ তল্লাট ছেরে পালিয়েছিল।
শেষটায় জল এসে ঢুকল আমার লিচুবাগানে।
আগে ছিল আমার বাড়ির সামনের গাছলাপালার সবুজ, তারপর কাজলধারার কালো জল,তারপর ফের ধানখেতের কাঁচা সুজ এবং সর্বশেষে কালাই পাহাড়ের নীল রঙ। এখন আমার আর পাহাড়ের মাঝখানে শুধু নোরা ঘোলা জলের একরঙা উদরী রোগীর ফুলে উঠা পেটের মতো এক ভয়াবহ সত্তা। তারই মাঝে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ঘর, আর কোনো ঘর মাথা অবধি ডুবিয়ে-জলের উপর শুধু টিনের চারখানা চাল বসে আছে, মোষ যে রকম সর্বাঙ্গ জলে ডুবিয়ে দিয়ে শুধু মাথাটা উপরে ভাসিয়ে রাখে। সবকিছু জলে একাকার বলে আসল নদীটি কোথায়, সে শুধু বোঝা যাচ্ছে, তার উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া কালো ঢিপি থেকে–মড়া মোষ শুয়োর, গোরু আরো কত কী! আর আমার বারান্দায় লক্ষ লক্ষ কেঁচো সাপ পর্যন্ত ঠিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
সত্যি বলতে কী, তখন এসব দেখেও দিখিনি। আজ দেখছি, আমার অজানাতে মন অনেক কিছু স্মরণ রেখেছে। আমি তখন পাঁচশটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত, যে-সব কাজ সম্বন্ধে আমার কণামাত্র অভিজ্ঞতা নেই।
তোমাদের জাতটা এমনিতে বড় ইনডিসিপ্লিণ্ড কিন্তু বিপদের সময় আমাদের তুলনায় তোমরা অনেক বেশী কমনসেনস ধর। আপনা থেকে কেমন যেন একটা ডিসিপ্লিন তোমাদের ভিতর এসে যায়। তা না হলে আমার সেই পাগলের মতো ছুটোছুটির ফলে ইষ্ট না হয়ে কী যে অনিষ্ট হত বলতে পারিনে।
সাত দিন ধরে আমি কলের মতো কাজ করে গিয়েছি আমি সম্বিতে ছিলম না। এমন কি, আমার জীবনের আপন ট্রাজেডি সম্বন্ধেও আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম।
অষ্টম দিনে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সম্বিতে ফিরলুম। ডাঙশ মেরে মানুষ একে অন্যকে অজ্ঞান করে। আমাকে ডাঙশ মেরে আনা হলো সম্বিতে।
বাঙালোয় এসে শুনলুম, মেবলের বাচ্চা হয়েছে।
.
১২ই সেপ্টেম্বর
তোমাদের সকলের মুখে শুনি, কর্ম করে যাবে, ফলোভের আশা ত্যাগ করে। ফল দেওয়া-নাদেওয়া ভগবানের হাতে। এই নাকি তোমাদের সর্ব অভিজ্ঞতা, সর্বশাস্ত্রের মূল কথা।
মা মেরী সাক্ষী, আমি বন্যার সাত দিন কোনো ফলোভের আশা করে কাজ করিনি। আমি আমার আপন প্রাণ বিপন্ন করে যাদের বাঁচিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ বন্যার পর কলেরায় মারা যায়। তাই নিয়ে আমি শোক করিনি। অন্য ফলের কোন প্রশ্নই তো আমার মনে ওঠেনি।