ক্লাব বাড়ির কোনো কোনো ব্যাঙ নিশ্চয়ই আমাকে লাথি মেরেছে, কিন্তু সেখানকার গণ্ডার, হিপো, অর্থাৎ মাদামপুর বিষ্ণুছড়া তাদের জিভের লকলকানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর জন্য ওঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয় কি?
তবে দেখো, আহুর মজদাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। আহির মনের কুর সর্পদংশনে আমার অন্তরাত্না যাতে করে জর্জরিত না হয়ে যায় তাই তিনি আমার ধনীতে ঢেলে দেবার চেষ্টা করলেন ক্লাব বাড়ির অযাচিত হৃদয়তার সঞ্জীবনী সুধারস।
কিন্তু জান, সোম, শক্ত ব্যামোতে ওষুধ যদি ঠিক মাত্রায় না দেওয়া হয় তবে ফল হয় উলটো। বিষ তখন সেই ওষুধ থেকে নূতন শক্তি সঞ্চয় করে নেয়। বীজাণুকে সিদ্ধ করে মারতে গিয়ে তুমি যদি জল যথেষ্ট না ফোঁটাও তবে জল আরো বেশী বিষিয়ে ওঠে। আমার বেলা হল তাই, এবং সেই জিনিসটাই আমার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিল। আহির মন আমাকে তার দাসানুদাস করে ফেলল।
আমি ক্লাব বাড়ির সদাশয়তা না দেখে, উপলদ্ধি করলুম, সংসারে যত বড় অন্যায় অবিচার হোক না কেন, ধর্মের অনাচার অধর্মের যতই প্রসার হোক না কেন, একদল লোক সেটাকে চাপা দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে যায়। এবং আশ্চর্য, তারা যে অসাধু তাও নয়। মাদামপুর বিষ্ণুছড়া এরা দুজনাই অতিশয় সহৃদয় ভদ্রলোক। এ পাপ ছড়িয়ে পড়লে অর্থাৎ আমাদের কেলেঙ্কারির কথা রাষ্ট্র হলে, উইরোপীয় সমাজের অকল্যাণ হবে এই আশঙ্কায় তারা সেটা চেপে রেখেছিলেন।
অর্থাৎ পাপ করলেই পুণ্যাত্মা তোমাকে ধরিয়ে দেবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন আমার বেলায়–সজ্জনরা সে পাপ লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করলেন।
এ-সম্বন্ধে বাকি কথা পরে হবে।
তুমি তখন ছুটি নিয়ে কাশী না গয়ায় কোথায় গিয়েছ।
এদিকে মধুগঞ্জে এল বন্যা।
দিন সাতেক ঝমাঝম বৃষ্টি। তারপর দিন তিনেক পিটির-পিটির। তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, কারণ আমাদের বছরের বরাদ্দ একশ বিশ ইঞ্চির তখনো একশ ইঞ্চি হয়নি। এমন সময় কোনো রকমের পূর্বাভাস না দিয়ে পাহাড় থেকে হুড়হুড় করে নেমে এল সাত-হাত-উঁচু জলের এক ধাক্কা। সঙ্গে নিয় এল বিরাট গাছের গুঁড়ি আর কুড়েঘরের আস্ত চাল। তার উপর আকড়ে ধরে আছে মৃত্যুভয়ে কম্পমান শত শত নরনারী, পশুপাখী, এমন কি, সাপ-বিচ্ছুও সকলের সম্মুখেই মৃত্যু যখন সশরীর বর্তমান মানুষ। তখন সাপকে মারে না, সাপ মানুষকে কামড়ায় না। ক্ষুধার উদ্রেকও নিশ্চয় তখন হয় না–একই বাঁশের উপর আমি তখন সাপের কাছে ইঁদুরকে বসে থাকতে দেখেছি। আর জলের তাড়া খেয়ে সাপ তো আমার ডিঙিতে আশ্রয় নিতে এসেছে কত গণ্ডা–ওদিকে মাঝিরা লগি দিয়ে জলে ঝপাঝপ মার লাগাচ্ছে তারা যেন না আসে তবু আসবেই।
মৃত্যভয়ে শঙ্কিত নরনারী উদ্ধারের জন্য চিৎকার পর্যন্ত করছে না। গোড়ার দিকে নিশ্চয়ই করেছিল। এখন বোধ হয় গলা ভেঙ্গে গিয়েছে। আর বাঁচাবে কে? যে কখানা নৌকো ভেসে যাচ্ছে, সেগুলো মানুষের ভারে এই ডোবে কি ঐ ডোবে। যে লোকগুলো নৌকোয় আশ্রয় পেয়েছে তারা আসন্ন মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়ে গিয়েছে বলা কঠিন। আর একটি মাত্র শিশুকেই তারা নৌকোয় স্থান দিতে নারাজ।
জলের উপর দিবারাত্র ভেসে চলেছে অগুনতি মড়া। গোরু, বাছুর, শেয়াল, কুকুর, মোষ-হাতি পর্যন্ত। ভেবে আমি কুলকিনারাই পেলাম না, পাহাড়ের উপর কতখানি তোড়ে জলের স্রোত নেমে আসলে একটা হাতি পর্যন্ত বেকাবু হয়ে নদীর জলে ভেসে এসেছে। একটা হাতি কোনো গতিকে সাঁতার কেটে পাড়ে এসে উঠলে। আমারই টিলার নীচে। দেখেই বুঝলুম। বুনো তখন সে নির্জীব, কিন্তু পারে না আশপাশে আতঙ্কের সৃষ্টি করে, সেই আশঙ্কায় ওটাকে গুলি করে মারব কি না যখন ভাবছি, তখন মধুমাধ। জমিদারির মাহুত উঁচু জায়গার সন্ধানে সে তার হাতি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আমার পিছনের টিলায়–তাকে দিব্য পোষ মানিয়ে নিয়ে গেল আপন হাতির সঙ্গে। বনের ভিতর যাবার সময় আমাকে সেলাম করে বলল, এ হাতি আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গেছে হুজুর। এ হাতি আর কখনো বনে ফিরে যাবে না, কারো অনিষ্টও করবে না। হাতি তো নেমকহারাম জানোয়ার নয়।
শুধু জল আর জল। বর্ষার প্রথম ধাক্কাতেই কাজলধারার কালো জল ঘোলা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে হয়ে গেল সাদা। কিন্তু ধবলকুষ্ঠের মতো কী রকম যেন বীভৎস সাদা নিয়ে। কোন কোনো সাপের গায়ে আমি এ রঙ দেখে শিউরে উঠেছি এবং বিষাক্ত কি না সে খবর না নিয়েই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি। এ জলের মাথায় যদি লাঠি মেরে কেউ তাকে মেরে ফেলতে পারত।
প্রথম ধাক্কাতেই বান ভেঙে দিল আমাদের নদীর পাড়। ডুবিয়ে দিল শহরের নীচ জায়গায় বাড়িঘর। ভাগ্যিস প্রথম জোরে মারটা এসেছিল দিনের বেলা, না হলে কতো লোক এবং আমাদেরই চেনা লোক যে এক ঘুম থেকে আরেক ঘুমে চলে যেত তার সন্ধান পর্যন্ত আমরা পেলুম না। তারা আশ্রয় নিল জাত-বেজাতের নৌকোয়, বাকিরা এসে উঠল টিলা-টালার উপরে। আমাদের মধুগঞ্জে আছে কটাই বা তাবু! তারই সব কটা পড়ল এখানে-ওখানে। বাকিরা টিলা থেকে ডাল-পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তুললে চালাঘর। মুদীরাও আশ্রয় নিয়েছে সেইখানেই–আর যাবেই বা কোথায়? তোমার পরিবারের আশ্রয়ের জন্যে আমি আমার ভাওয়ালি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে নৌকা এনে বাধা হল আমার টিলার নীচে বটগাছের সঙ্গে।