আবার দেখো, কিছুদিন পরে সায়েব মেম দুজনাতে ফের বেশ ভাব হয়ে গেল। আরদালি যে বরখাস্ত হল তা নয়, আর্মস্ট্রঙের হারেমগনও বন্ধ হল না। ক্লাবে যেন তখন এক সুরসিক বলেছিল, সিভিল সার্জন পরিবার দিশী-বিদেশী দুই খানাই পছন্দ করেন।
এ হল প্রাণবন্ত নরনারীর স্বাভাবিক সৌভাগ্য–তারা একটা মডুস ডিভেণ্ডি, বেঁচে থাকার পন্থা খুঁজে নিতে পারে। পুরুষ কিংবা স্ত্রী সেখানে কেউই পদদলিত কিংবা অপমানিত হয় নি। অপামান, আমার মনে হয়, আত্মার মৃত্যু। আর আত্মা যখন মরে যায় তখন মানুষ হয়ে যায় পশু নির্মম জিঘাংসু এবং মারাত্মক পশু, কারণ আত্ম মরে গেলেও তার থেকে যায় বুদ্ধিবৃত্তি, যে বুদ্ধিবৃদ্ধি পশুর নেই। সে তখন হয়ে যায় হাইড। যত রকম পাশবিক, নারকীয় জঘন্য পাপ তখন সে করতে পারে তার আহির-মনীয় বুদ্ধি, ছলচাতুরী দিয়ে।
আমারও তাই হয়েছিল। কিন্তু তার সব কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
ঐ সময়ের অনেক কিছুই আমার মনে পড়ছে। তার একটা তোমাকে বলি।
জানো তো, পাদ্রী জোনস গুঁড়ি-গুডি লোক তোমরা যাকে বলো, ভালোমানুষ’। ধার্মিক লোক আকসারই তাই হয়। যদিও তার অজানা ছিল না যে আমি তাকে পন্তি বর্জন করেছি, তবু ভদ্রলোক রাস্তায় একদিন বেমক্কা দেখা হয়ে যাওয়াতে আমার সঙ্গ নিল আমি তো তাকে গুড ইভনিং বলে কেটে পড়ার চেষ্টাই করেছিলুম। আমি যে আশাস্তিতে আছি সে তো তার অজানা ছিল না, কিন্তু সে অবস্থাতে যে পাদ্রীর উপদেশে কোনো ফললাভ হয় না, সে তত্ত্বও তিনি জানতেন না।
ইতি-উতি ডোন্ট পোর্ক ইয়োর নোজ ইন মাই অ্যাফেয়ার্স, (আপন চরকায় তেল দাওগে-এর তুলনায় অনেক মোলায়েম) এটা শোনার জন্য বেশ তৈরী হয়েই ভদ্রালোক আমাকে বললে, যার মর্মার্থ, ইতি-উতিটা বাদ দিয়ে বলছি সাদামাটা ভাষায়ই তোমার কী বেদনা তা আমি জানি না। কিন্তু জানি, তুমি সুশীল ছেলে,তুমি ধর্মভীরু। তাই বলছি, ভগবান যদি তোমাকে অসুখী করে থাকেন তবে নিশ্চয়ই তার কোনো কারণ আছে। যখন সে যুক্তি আমরা খুঁজে পাচ্ছিনে তখন তুমি এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দাও না কেন যে,আমার তোমার চেয়েও অসুখী লোক এ সংসারে আছে।
সারমন্টার মধ্যে খানিকটে সত্য আছে নিশ্চয়ই। ঐ যে আমাদের বাদরটা হার্ভে,কী কুচ্ছিত তার চেহারা, আর তার বিদঘুঁটে জামাকাপড় আর চলন বলন। ক্লাবে কোনো মেয়ে তার সঙ্গে কথা কইতে চায় না, তার গা থেকে যা দুর্গন্ধ বেরোয় তাতে আমারই নাক চেপে বাপ বাপ করে পালাই। খাস খানদানী ইংরেজদের বাচ্চা,পাদ্রী টিলার যে কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করে যাতে উঠতে পারে কিন্তু বেচারীর কী দুরবস্থা! সেখানেও ত্রিসমারের বাত্তিরে গিয়ে পাত্তা পায়নি-কোন মেয়ে তার সঙ্গে নাচেনি। নেচেছিলেন একমাত্র বুড়ী পাদ্রী-মেম। তার কথা আলাদা, তিনি অসাধারণ নারী।
আমি সে রাত্রে ক্লাব এড়াবার জন্যে পাত্রী টিলায় গিয়েছিলুম। মেয়েরা যা খুশি হয়েছিল তার স্মৃতি চিরকাল আমার মনের মধ্যে রইল। সেই আনন্দ সর্বাঙ্গে তরের মতো মেখে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছি, তখন দেখি হার্ভে তার মুখে দে আর গ্লানি থ গতিতে বাড়ি ফিরছে।
আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম, কিন্তু, জান সান্ত্বনাও পেয়েছিলুম পাদ্রীর সামনের কথা ভেবে যে, আমার চেয়েও দুঃখ এ সংসারে আছে। বাড়িতে, আমার বুকের ভিতর যে জ্বালা জ্বলে জ্বলুক; কিন্তু সমাজ তো আমাকে ঘেন্না করে না।
এই সান্ত্বনা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন দেখি, টেবিলের উপর একটা ক্রিসমাস প্যাকেট খুলে দেখি হাউসম্যানের কবিতার বই। আমার বন্ধু আর্নল্ড পাঠিয়েছে। ও বই আমি সে রাত্তিরে পেতুম না, কারণ সেদিন মধুগঞ্জে ডাক বিলি হয় না। কিন্তু পোস্টমাস্টার লাহিড়ী গভীর রাত্রেও ইংরেজদের ক্রিসমাস ডাক বিতরণ করাত।
কবিতার বই যেখানে খুশি পড়া যায়। খুলতেই চোখে পড়ল,
Little is the luck I’ve had
and oh, tis comfort smmall
To think that many another lad
Has had no luck at all.
যে সান্ত্বনাটুকু নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলুম, সেই মুহূর্তেই সেটি অন্তর্ধান করল। আর্নল্ড নয়, পাঠিয়েছিল আহির মন।
.
২৫শে আগস্ট
সব খবরই ক্রমে ক্রমে ক্লাব-বাড়িতে পৌঁছেছিল সে কথা আমি জানি, কি চেহারা নিয়ে পৌঁছেছিল সে কথা বলতে পারব না। একই ঘটনা স্বচক্ষে দেখে দুই সত্যবাদী লোক যে কি রকম ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দিতে পারে সে সত্য, পুলিশের লোক হিসেবে, আমরা বেশ ভালো করেই জানি এবং সেই অমিলের ফাঁক দিয়েই যে আসামী নিষ্কৃতি পায় সে তত্ত্বও আমাদের অজানা নয়।
আণ্ডাঘর আমাকে বেকসুর খালাস হয়তো দেয়নি, কিন্তু একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হলুম যে, এ ব্যাপার নিয়ে ক্লাবের মুরুব্বিরা বেশী নাড়াচাড়া করতে তো চানইনি, যতদূর সম্ভব ধামাচাপা দেবার চেষ্টাও করেছিলেন। এ স্থলে যে তারা ঘুমন্ত কুকুরটাকে শুধুমাত্র জাগাতে চাননি তাই নয়। বার্কিং ডগটাকে পর্যন্ত স্ট্রাল করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকখানি সক্ষমও হয়েছিলেন।
বক্সওয়ালাদের নিয়ে আমিও বেখেয়ালে আর পাঁচজনের মতো ছোট খাটো ঠাট্টা রসিকতা করেছি, কি যখনই তলিয়ে দেখেছি, তখনি মনের ভিতর লজ্জা পেয়েছি। বক্সওলাদের তুলনায় আমি ভদ্র সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোক, আর এ সংসারের রীতি, দৈবদুর্বিপাকে বড়র যখন মাথা নিচু হয় তখন ছোট তাই দেখে হাসে। সার্ভ হিম রাইট, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে, তার মুখে তখন ঐ এক কথা। এই নিয়ে বাংলায়ও একটা জোরদার প্রবাদ আছে, সেটা নিশ্চয়ই তোমার জানা, কারণ বাংলা শেখার সময় তুমিই আমাকে এই প্রবাদের বইখানা দিয়েছিলে। বাঙলাটা আমার আর মনে নাই, তাই ইংরিজীটাই দিচ্ছি। হুয়েন দি এলিফেন্ট সিকস ইন টু দি মায়ার, ইভন দি ফ্রগ গিভ হিম এ কি। আমাদের দেশের তুলনায় তোমাদের দেশে বড়-ছোটর পার্থক্য অনেক বেশী তাই বোধ করি তোমাদের তুলনাটায় প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তিটা ফুটে উঠেছে বেশী।