এসব অভিজ্ঞতার সত্যতা সম্বন্ধে তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তবে তারই একটা ক্ষুদ্রতর দৃষ্টান্ত আমিতোমাকে দিতে পারি যেখানে তুমি এ-সব অভিজ্ঞতার ক্ষীণতর রূপ খানিকটে যাচাই করে নিতে পারবে।
কোনো কোনো রুগীকে সারাবার জন্য তিন তিন বার অজ্ঞান করে অপারেশন করতে হয়। প্রথমবারে সে অতটা ডরায় না, কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় বারের মধ্যে কয়েকখানি, এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ তার কী করে কেটেছিল, সে কথা তুমি তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে অনায়সেই জেনে যাবে। তিন বারের পরও যদি সে না পারে, তখন, জান সোম, সে আর দ্বিতীয় কিস্তিতে চতুর্থ বারের মতো অপারেশন করাতে সম্মত হয় না। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে, এদিক ওদিক লুটতে লুটতে খাট থেকে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণা এড়াবার জন্য আত্মহত্যা করবে বলে আকুতি মিনতি করে বিষের জন্য, কিন্তু তবু আবার অপারেশন করাতে রাজী হয় না। তার সর্বক্ষণ মনে পড়ে, প্রথম অপারেশনের ক্লোরোফর্মের জড় নেশা কেটে যাওয়ার পর সে কী অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিল, চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত ছিল না, গোঙরাতে গোঙরাতে মুখ দিয়ে শুধু ফেনা বের করেছিল।
সোম,আমার কিন্তু নিষ্কৃতি ছিল না। চিন্ময় বেদনার জগতে কোনো সরকারী আইন নেই,ডাক্তারী কোড নেই যে রোগীর বিনা অনুমতিতে তার অপারেশন করতে পারবে না। আমার মুখের প্রথম অপারেশনের ফেনা শুঁকতে না শুঁকতেই আমাকে সেই দুশমনের মতো যমদূতদর্শন ডোমেরা টেনে নিয়ে যেত অপারেশন ঘরের দিকে। সেখানে আমাকে অপারেশন করা হত অষ্টাদশ শতাব্দরি পদ্ধতিতে–যখন ক্লোরোফর্ম আবিষ্কৃত হয়নি। তারা আমাকে দুপায়ে তুলে ধরে মাথার উপর ঘোরতে ঘোরাতে ভিরমি খাইয়ে কিংবা তাতেও না হলে মাথায় ডাঙশ মেরে অজ্ঞান করে অপারেশনের জন্য তৈরি করত। ছুরির ঘা ক্লোরোফর্মের নেশাকে কাটতে পারে না বলে আজকের দিনে অপারেশন চলে রোগীকে যন্ত্রণা না দিয়ে। আমার বেলা কিন্তু ছুরির ঘা আমাকে সম্বিত ফিরে নিয়ে আসত আর আমি সজ্ঞানে দেখলুম, আমার উপর ছুরি চলছে। পাছে আমার বিকৃত চিৎকারে সার্জেন্টদের অপারেশন করাতে বাধা জন্মায় তাই ডোমরা আমার মুখ চেপে ধরে রাখত। গুঙরে গুঙরে শরীর যে তার টরচার থেকে খানিকটে–সে কত অল্প-নিষ্কৃতি পাবে তার সর্ব পন্থা বন্ধ।
চোখের সামনে মেব্ল্কে দেখতে হত প্রতিদিন।
কেন আমি তাকে খুন করলুম না প্রথম দিনই?
কিন্তু তার দোষ কী? সে তো আর আমাকে ত্যাগ করে ঐ বাটলারটাকে গ্রহণ করেনি। বদ্ধ পাগলও আমাদের দুজনকে একাসনে বসিয়ে বিচার করবে না। আমার মনে হয় বহু বাজারের মেয়েও তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি।
ঐখানেই তো ভুল। জয়সুর্যের থাকবার মতো কিছুই নেই, সত্য, কিন্তু তার একটা সম্পদ আছে যেটা আমার নেই। সে সম্পদ কুকুরবেড়ালেরও থাকে, সে কথা বলে লাভ কী? যে মানুষ দু মিনিট বাদে মরবে তাকে কি এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়, তুমি মরে যাবার পরও অনেক কুকুরবেড়ালও বেঁচে থাকবে, তাই বলে কি তাদের বাঁচাটা তোমার মরার চেয়ে বড়? মেবল্ তো নিয়েছিলো মাত্র এইটুকুই। তাকে ও জিনিস যে কোনো পুরুষই দিতে পারত। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ যে রকম নর্দমা থেকে বুটে তুলে তুলে ভাত খায়। তাকে কি আমরা দোষ দিই?
গোড়ার দিকে আচ্ছন্নের মতো বসে বসে এই সব চিন্তা করেছিলাম কিন্তু তখন সব ছিল ভেঁড়াছোঁড়া! কোনো বিশেষ চিত্তা বা যুক্তি নিয়ে সেটাকেযে তার চরম ফৈসালায় ফেলে গ্রহণ বা বর্জন করব সে শক্তি আমার ছিল না। ফড়িঙের মতো আমার মন এ-ঘাস থেকে ও-ঘাসে ক্ষণে ক্ষণে লাফ দিত, কোনো জায়গায় স্থির হয়ে বসে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারত না। আজও যে পারি তা নয়। তবে কয়েকমাসের জন্য একবার পেয়েছিলুম, এমন কি সেই অনুযায়ী কাজও করেছিলু, এবং সেইটে বলবার জন্যই তো এই চিঠি লেখা। সে কথা পরে হবে।
সব জেনে বুঝেও আমার মন অহরহ এক অন্ধ আক্রোশে ভরে থাকত।
তুমি তো জানো আমাদের সিভিল সার্জন আর্মস্ট্রঙের মেম তার ছোঁকড়া আরদালিটাকে মোটর-সাইক্ল কিনে দিয়েছিল। এ শহরে কে জানতনা তার রসময় কারণ। ওদিকে আর্মস্ট্রঙ তো আমার মতো মন্দভাগ্য ছিল না? মেম যখন ভারতীয় তাগড়া ছোকরার বাদামী রঙ, কালো চুল আর প্রাচ্যদেশীয় বর্বর চোখের (মাফ করো সোম, আমি তোমাকে অপমান করছিনে,কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমার দেশে খানদানীরা যে রকম আমাদের তুলনায় ঢের বেশী মার্জিত, ঠিক তেমনি তোমাদের চাষা-ভূষোরা আমাদের মজুরদের চেয়ে অনেক বেশী প্রিমিটিভ অনেক বেশী সেকসি) প্রাণ-মাতানো নেশায় মজে গেল, তখন গোরার দিক আমস্ট্রং বেশ কিছুটা চোটপাট করেছিল। এমন কি, আমার মনে হয়ে সে ইচ্ছে করলে আরদালিটাকে তাড়িয়ে দিতে পারত-মেম আর কী করতে পারত। কিন্তু সে করেনি। আমার মনে হয়, প্রাণবন্ত স্বাভাবিক যৌনশক্তিশালী পুরুষ এসব ব্যাপারে অনকেখানি ক্ষমাশীল হয় টু হেল চুলোয় যাকগে, বলে সে শাস্তুমনে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ফিরে যায়। ঠিক কথা, কারণ আর্মস্ট্রঙ গিয়েছিল তেরিয়া হয়ে, উইথ ভেজেস। ঐ যে, কী সে বকওয়ালাটার নাম যে তার টিলায় কুলী মেয়েদের হারেম পুষত? আমস্ট্র তো প্রায়ই ওদিক পানে না-পাত্তা হয়ে যেত।