আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি এ রকম সাধুলোক কী করে এ রকম নোংরামি করতে পারে। তিনি নিজে আমার খাশ-কামরায় স্বীকার করেছিলেন বলেই শেষটায় আমার প্রত্যয় হল।
কী বিড়ম্বিত জীবন! ভগবান ভদ্রলোককে স্বাভাবিক যৌনক্ষুধা দেননি। তার অনৈসর্গিক যৌনক্ষুধাকে তিনি অদ্ভুত বিক্রমে কত বৎসর চেপে রেখে রেখে হঠাৎ একদিন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে কুকর্মটা করে ফেললেন শুনেছি তোমাদের সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যেও দৈবাৎ কখনো এরকম ধারা হয়েছে। সে ঘটনা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকের মুখে যে আত্মবমাননার প্রকাশ দেখেছিলুম, তার দাগ আমার মন থেকে কখনো উঠবে না। ভদ্রলোক শেষটায় বলেছিলেন,’আমাকে এখন সমাজঘেন্না করবে,কুষ্ঠরোগীকে মানুষ যেরকম বর্জন করে চলে। আমি সমাজের জন্য কী করেছি, সেকথা স্মরণ করবে না– আমি তাকে দোষও দিইনে কিন্তু আমার সতী-সাধ্বী স্ত্রী, যিনি ভাবতেন আমি ধ্যান ধারণায় আত্মসমর্পণ করেছি বলে তাকে অবহেলা করি, যার পুত্রোৎপাদন-ঈপ্সাকে পর্যন্ত আমি সম্মান দিইনি, তিনি কী ভাববেন?
.
ওঃ? এ কেসটা ধামাচাপা দিতে তোমাকে কী বেগই না পেতে হয়েছিল। রায়বাহাদুর কাশীর যদি অযাচিতভাবে গুহ্য সন্ধিসুড়ক আমাদের বাতলে দিতেন, তবে আমরা চৌধুরীকে বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু আমার বিস্ময়ের অবধি নেই, হিন্দু সমাজের বিরাট পাণ্ডা রায়বাহাদুর কী করে এতখানি দরাজ-দিল হলেন। তবে হ্যাঁ শুনেছি, তোমাদের সাধু-সন্ন্যাসীর ভিতরও এরকম কিছু একটা হলে অন্য সন্ন্যাসীরা তাকে খুন করে না। হিমালয়ের উত্তর প্রদেশে তাকে পাঠিয়ে দেয়। তোমাদের ধর্ম সত্যই বড় অদ্ভুত। কত শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলে তোমাদের সাধুরা কত সত্য আবিষ্কার করেছে, আর তার থেকে পেয়েছে অন্তহীন সহিষ্ণুতা।
তুমি হয়তো জান না, চৌধুরী আমাকে এখনো দক্ষিণের এক আশ্রম থেকে মাঝে মাঝে চিঠি লেখে। শুনে খুশী হবে তার স্ত্রী তার সঙ্গে আছেন।
দু বৎসর কঠোর সংযমে নিজেকে মেলের কাছ থেকে দূরে রেখে এক গভীর রাত্রে নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি তার কাছে যাই। কী হয়েছিল, তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করবনা।
সেই রাত্রে ভোরের দিকে মেবল্ জয়সূর্যের ঘরে যায়। সেই ভোরেই সে আমার পায়ের উপর তার মাথা রেখে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল। তার চুল ভিজে গিয়েছিল, আর পা ভিজে গিয়েছিল। আমাদের দুজনের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরয়নি।
থাক।
.
২২ শে আগস্ট
মে যদি মরে যেত, তবে কি আমার এর চেয়ে বেশী কষ্ট হত? বলতে পারব না। হঠাৎ যদি আমি অন্ধ হয়ে যেতুম, তাহলে কি বেশী কষ্ট পেতুম? বলতে পারব না। তখনো বলতে পারিনি, আজও পারব না।
আমি বিমুটের মতো বসে কয়েক দিন কাটাই।
আমার মনে হয় বড় শোক যখন আসে, তখন অনেক ক্ষেত্রেও মানুষ প্রথম ধাক্কাতেই তার বেদনা পূর্ণরূপে উপলদ্ধি করতে পারে না। আস্তে আস্তে যেমন যেমন দিন যায়,সঙ্গে সঙ্গে অসহায় হরিণ শিশুর শরীরকে ঘিরে যেন পাইথনের পাশ একটার পর একটা করে বাড়তে থাকে শুনেছি, সে নাকি তখন আর আর্তস্বরে চিৎকার পর্যন্ত করে না। শেষ পাশদেওয়ার পরে পাইথন লাগায় আস্তে আস্তে চাপ। আমি কখনো দেখিনি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, হরিণ কি আমার চেয়ে বেশী কষ্ট পায়?
ফাঁসির আসামীও ঘুমোয়। ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই নাকি তার মনে পড়ে অমুক দিন তার ফাঁসি। নিদ্রার কোল থেকে প্রাণ-রস যুগিয়ে নিয়ে মানব-শিশু যখন জাগলে, তখনই তার স্মরণ এল, সেই প্রাণটি তার অমুক দিন যাবে। পড়েছি, কোমর অবধি পুঁতে মানুষকে যখন পাথর ছুঁড়ে খুঁড়ে বধ করা হয়, তখন প্রথম কয়েকটা পাথরের ঘা খেয়েই সে নাকি অজ্ঞান হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। চতুর্দিকের নরদানবরা তখন নাকি তাড়িতাড়ি ছুটে এসে জল দিয়ে তাকেচৈতন্যে নিয়ে আসে। সম্বিতে ফিরে এসে সে নাকি প্রথমটায় বুঝতে পারেনা, সে কোথায় ট্রেনে ঘুম ভাঙলে আমরা যে রকম প্রথমটায় বুঝতে পারিনে আমরা কোথায়। তারপর আবার দুসরা কিস্তির প্রথম পাথরের ঘা খেয়েই নাকি সে সেই নির্মম সত্য বুঝতে পারে, তাকে পাথর ছুঁড়ে দুরে মারা হচ্ছে। বর্ণনায় পড়েছি, তাকে নাকি অন্তত বারপাঁচেক এক রকম সম্বিতে ফিরেয়ে এনে মারা হয়।
শুনেছি, যে লোক যতটা খুন করে, চীন দেশে নাকি তার ততবার ফাঁসি হয়। কিন্তু ফাঁসি একবারের বেশী হতে পারে কী করে? তোমরা এই নিয়ে একটা ঠাট্টা করো না, অমুক লোকটার তিন মাসের ফাঁসি? কিন্তু তাও হয়। বিদগ্ধ চীনেরা তারও একটা সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছে। আসামীর গলায় ফাঁস দিয়ে আস্তে আস্তে তার দম বন্ধ করে আনতে আনতে তাকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। অজ্ঞান হওয়া মাত্রই ফাঁস ঢিলে করে দিয়ে জল ঢেলে, হওয়া করে তাকে ফের সম্বিতে আনা হয়। যে যতবার খুন করেছে, তার উপর এই প্রক্রিয়া তবার চলে। প্রতিবার সম্বিতে আসামাত্র তার কী মনে হয় ভেবে দেখো।
ধন্য সে-সব লেখক, যারা এসব মর্মাস্তিক ব্যপারে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। আমার মনে হয়, হয় তারা স্যাডিস্ট, নয় তারা আপন জীবনে, আমারই মতো কোনো । এক কিংবা একাধিক নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছেন।
এখনো বলছি, শারীরিক ফাঁসির সংখ্যার একটা সীমানা আছে। পাঁচ-সাত বার করার পর আসামী নিশ্চিয়ই আর সম্বিতে ফিরে আসে না অচৈতন্য অবস্থা থেকে মৃত্যুর অতল গহ্বরে ডুবে যায়। কিন্তু মনের ফাঁসি, আত্মার ফাঁসির সীমাসংখ্যা নেই। বাইরে প্রকৃতিতে যে রকম রেণুতে রেণুতে প্রতিক্ষণ কোটি কোটি নবজন্মের সৃষ্টি একই মানুষ সেই রকম ভিতরে ভিতরে মরে কোটি কোটি বার। এবং প্রতি দুই মৃত্যুর ভিতর যে সম্বিত, তখন সে সম্বিত শুধু তাকে জানিয়ে দেবার জন্য, এই শেষ নয়, এই মৃত্যুযন্ত্রণাই শেষ মৃত্যুযন্ত্রণা নয়, আরো অনেকগুলো সম্মুখে রয়েছে।