পাশের খাটে মেব্ল্ শুয়ে। তার সোনালী ঢেউ-খেলানো এলো চুল চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে বালিশের উপর এঁকেছে বিচিত্র নক্সা। তার কপালে গামের একটু একটু ভেজার আভাস, চাঁদের আলো তারই উপর সামান্য চিকচিক করছে, বিলের ভেট’ ফুলের পাপড়ির উপর এই আলোই আমি অনেকবার দেখেছি ভাওয়ালির জানালা দিয়ে। মেবলের হাত দুখানি তার শরীরের দুদিকে আলসে লম্বমান হয়ে অর্ধমুষ্টিবদ্ধ যেন দুটি ভেট-ফুলের কুঁড়ি। আর তার সমস্ত কিশোর তনু যেন গাদা করে রাখা শিউলি ফুলের পাপড়ি-হ্যাঁ, মনে পড়ে গেল শিউলি ছিল মেবলের সবচেয়ে প্রিয় ফুল।
এই গরমের দেশে শীতের দেশের মেয়েকে চাঁদের আলোতে কী রকম অদ্ভুত, রহস্যময় দেখাত। আজ যদি হঠাৎ দেখি, আমার লিচুবনের ঘন সবুজের উপর গাদা গাদা সাদা বরফ জমেছে, তাহলে যে রকম সমস্ত বাগানখানা এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ভরে উঠবে।
মেবলের এই নিশিকান্ত সৌন্দর্য আমার আত্মার ক্ষুধাকে অনির্বচনীয় তৃপ্তিতে কত শতবার ভরে দিয়েছে। আস্বচ্ছ ফিকে বেগুনি রঙের মসলিন নাইট-ড্রেসে জড়ানো মেলের শরীর আমার কবি-মানসের শুষ্ক মৎপাত্রকে অমৃতরসে বার বার ভরে দিয়েছে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দিত আমার সর্ব-ধমনীতে এক অদম্য যৌনক্ষুধা।
মনে আছে, সোম, তুমি আর আমি একদিন মফস্বলের এক গ্রামে নিষ্ক্রিয় ক্রোধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম, সমস্ত গ্রামখানা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল–জল ছিল না। বলে আমরা নিষ্ফল আক্রোশে শুধু ছটফট করেছিলুম।
সে আগুন তবু ভালো। নিরন্ন বিধবার শেষ কথাখানি পুড়িয়ে দিয়ে সে আগুন তবু তো তৃপ্ত হল।
আমার এ বহ্নিজ্বালার শেষ নেই। পিরামিডের উপরে দাঁড়িয়ে আমি একদিন গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে সাহারার মরুভূমির দুরদিগন্তের শুষ্ক তৃষ্ণার দিকে তাকিয়েছিলুম, আর তার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে ভগবানের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলুম। আহির মন আমার সর্বশরীরে সেই সাহারার জ্বালা জ্বালিয়ে দিল।
শরীরে এ জ্বালা নিয়ে মানুষ সমাজে মিশতে পারে না। আমি ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করে দিলুম, লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমিয়ে কমিয়ে শেষটায় একেবারে আলেকজাণ্ডার সালকাক হয়ে গেলুম। বিষ্ণুছড়া আর মাদামপুরের মেয়েদের ফোঁসফেঁসানি আর ছোবলাছুবলি থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার কোনো কষ্ট হয়নি; কিন্তু পাত্রী টিলার মেয়েদের কলকল উহাস্য, তাদের লাজুক নয়নে আধা-প্রেমের ক্ষীণ আভাস আমার জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে তাকে করে দিল আরো ফাঁকা। কে যেন বলেছে, দি মোর লাইফ বিকামস এপটি দি হেভিয়ার ইট বিকামস টু ক্যারি ইট’। জীবন যতই ফাঁকা হয়ে যায়, তাকে বহন করা হয়ে যায় ততই শক্ত। বড় খাঁটি কথা বলেছে। তবু আমি জীবনের সেই শূন্য ধামা বইতে পারতুম, কিন্তু সে ধামার সর্বাঙ্গে ছিল বিছুটি।
খুব সম্ভব আমারই দেখাদেখি মেবুও বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কী ভেবে বন্ধ করল জানিনে। তার মনের কথা কিন্তু আমি তোমাকে বোঝাতে যাব না। তার প্রতি আমি অবিচার করেছি কি না, তার বিচার একদিন হয়তো হবে, কিন্তু তার মনের কথা বলতে গিয়ে আমি যদি উনিশ-বিশ-করে ফেলি তবে সে অবিচার আমাকে কেউ ক্ষমা করবে না।
আমার ভিতরকার ডন কিকসট ক্রমে ক্রমে কাতর হতে হতে রোগশয্যায় পড়ল। আর আমি, ও-রেলি, আস্তে আস্তে হ্যামলেটের রূপ নিতে আরম্ভ করলুম। বরঞ্চ হ্যামলেট বক্তৃতা ঝাড়তে প্রচুর সামান্যতম প্রভোকেশনে সে বরবর করে নানা প্রকারের দার্শনিক রায় জাহির করত এন্তার তোমাদের যাত্রাগানে যে রকম ক্ষীণতম প্রভোকেশনে। নায়ক-নায়িকা দুরে থাক, পাইক-বরকন্দাজ পর্যন্ত লম্বা লম্বা গান গাইতে আরম্ভ করে। আমার মুখের কথাও শুকিয়ে গেল।
বেচারী মেবল্। গোড়ার দিকে সে আস-কথা পাশ কথা বলে বলে আমাকে আমার কচ্ছপের খোলের ভিতর থেকে বের করবার চেষ্টা করেছিল; শেষটায় সে চেষ্টাও ছেড়ে দিলে।
তখন আমি খেতে আরম্ভ করলুম মদ। মাস তিনেক দিনরাত্তির আমি ভাম হয়ে পড়ে থাকতুম। বাটলার জয়সূর্য, যে কি না বানেশ্বরী মালের পাট জলের মতো ঢকঢক করে গিলতে পারে, সে পর্যন্ত আমার পানের বহর দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেল। কখনো বলে হুইস্কি ফুরিয়ে গেয়েছে, কখনো বলে সোডা নেই। তারপর একদিন মাতাল হয়ে তার গালে মারলুম ঠাশ ঠাশ করে চড়। সম্বিত ফিরে বড় লজ্জা পেয়েছিলাম, সোম। আমি কি অশিক্ষিত বকস্ওয়ালা যে আমি এ রকম অন্যায় আচরণ করব?
মদ খেয়ে লাভ হয়নি। মদ খেলে মানুষের যৌনক্ষুধা উগ্রতর হয়, তৃপ্তির ক্ষমতা কমে যায়। আমার অতৃপ্তির আক্ষোভ তাই মদ খেয়ে কখনো কখনো বিকট রূপ ধরেছিল। তার কথা বলতে আমার ঘেন্না ধরে।
কিন্তু আসল কথাটা আমি শুধু এড়িয়েই যাচ্ছি। আমি শুধু বোঝাতে চাই, অমি কী কঠোর যন্ত্রণার ভিতর আমার জীবনটা কাটালুম, আর সেইটে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছিনে। কিন্তু এ দুর্দৈবে আমি একা নই। তোমার মনে আছে চৌধুরীর কেসটা? ভদ্রলোক কী শান্ত, দয়ালু প্রকৃতির, গরীব-দুঃখীদের ভিতর তার দান-খয়রাতের কথা কে না জানে? আর কী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন তার স্ত্রী। দেখে মনে হত অনন্তযৌবনা–তাঁর ছেলেমেয়ে হয়নি। তার ঘাড়টির কথা তোমার মনে পড়ে কি? রাজধানীর গর্বনিয়ে যেন সে ঘাড় তার মাথাটি তুলে ধরত। একদিন তার সে খাড় নিচু হয়েছিল–আমি অবশ্য স্বচক্ষে দেখিনি। তার স্বামী যেদিন হোমোসেকসুয়েল কেসে ধরা পড়লেন।