এখনো মারে। আমার এ জীবন-চৈতন্যের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মন ঐ কথাই ভাববে। আমি শেষ দিন পর্যন্ত ইডিয়ট ইম্বেসাইলের মতো খাদ্য শুধু চিবিয়েই যাব, কখনো গিলতে পারব না। এই যে পাঁচ লক্ষ ক্যাঞ্চল্লাইটের জোর সার্চলাইট আমার চোখের উপর জ্বলছে সেটাকে কখনো সুইচ-অফ করতে পারব না।
নিরাশ হয়ে আমি এক বৎসর ধরে বহু ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি। সব ধর্মই দেখি সন্ধ্যান করে একই বস্তু–তার নাম স্যালভেশন, মোক্ষ, নির্বাণ, নজাত। কিন্তু আমি তো স্যালভেশন চাইছিনে? আট বছরের বাচ্চা কি সুন্দরী কামনা করে?
তোমরা অর্থাৎ প্রাচ্যের লোকই তাবৎ ধর্ম বানিয়েছ। আমরা পশ্চিমের লোক কী এক অদ্ভুত যোগাযোগের ফলে তারই একটা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, স্যালভেশন জিনিসটের প্রতি আমাদের ক্ষুধা নেই বলে আমরা ধর্মটা নিয়েও নিইনি। তা না হলে এদিকে বলছি, কেউ ডান গালে চড় মারলে বা গাল এগিয়ে দেবে,’ ওদিকে দেখো জনদের মারার জন্য আমরা শত শত কৌশল বের করছি, লক্ষ লক্ষ লোক মারছি। শুধু কি তাই? ডান গালে চড় মারলে বাঁ গাল এগিয়ে দেবে, এ ধর্মে যে লোক বিশ্বাস করে না তাকে এটা গেলাবার জন্য কত শার্লমেন কত পোপ কত লোককে মেরেছে! পাদ্রীটলার বুড়ো জোনকে বাদ দাও। বাদবাকি মিশনারিরা কী করছে? অসহায় নিরুপায় নিগ্রোদের জীবন অতিষ্ঠ করে তাদের ক্রীশ্চান বানাচ্ছে।
শুধু একটা ধর্মে আমি কিছুটা হদিস পেয়েছি। এবং আশ্চর্য সে ধর্মে আজ পৃথিবীতে বিশ্বাস করে বড় জোর দশ লক্ষ লোক। পার্সীদের ধর্ম, জরথুস্ত্রী ধর্ম।
জরথুস্ত্রী বলেন, সৃষ্টির প্রথম থেকেই আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব। আলোর প্রতীক আহুর মজদা আমাদের ভাষায় ভগবান আর অন্ধকারের প্রতীক আহির মন আমাদের ভাষায় শয়তান। জরথুস্ত্রীদের মতে যারা আহুর মজদার পক্ষে তাদের বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে জয়ী হবেন তিনিই। আহির মন আহুর মজদার সঙ্গে পেরে উঠবে না।
সংসারে যা কিছু সত্য শিব সুন্দর তা আহুর মজদার সৃষ্টি আর যত কিছু মিথ্যা, অমঙ্গল, কদর্য তা আহির মনের।
তবে কোন সুস্থ মানুষ এই শয়তানের পক্ষ নেবে?
সেই তো মজা, সোম, সেই তো মজা।
দেখোনি, এ সংসারে উন্নতির জন্য, স্বার্থের খাতিরে মানুষ কতখানি মিথ্যাচারী, ক্রর, মিত্রঘ্ন হয়। আমরা পুলিশের লোক, আমাদের বিশ্বাস এই ধরনের লোকই পৃথিবীতে বেশী। এরা মুখে ভগবান আহুর মজদাকে মানে, পুজো চড়ায়, শিরনি বিলোয়, গির্জাতে মা-মেরির সামনে মোমবাতি জ্বলে, কিন্তু আসলে কি এরা আহির মনকেই জীবনদেবতারূপে বরণ করে নেয়নি? আপন জানা-অজানায় এরা কি মেনে নেয়নি যে সুদূর ভবিষ্যতে যা হবার হবে, মজদা জিতুন আর মনই জিতুন, আমার এ জীবনকালে যখন দেখতে পাচ্ছি জ্বর কঠিন মিথ্যাচারী হয়ে আমি সাংসারিক উন্নতি করতে পারব না তখন আর গত্যন্তর কী?
এদের সবাইকে আমি দোষ দিইনে, সোম। কাচ্চা বাচ্চা রয়েছে, তাদের খাওয়াতে পরাতে হবে, আত্মীস্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছে বিশেষ করে স্ত্রীর কাছে যে তোমাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে প্রতিদিন মাথা হেঁট করে স্বীকার করা যে আমি জীবনযুদ্ধে হেরে, চলেছি কে শুনতে চায় সত্যাবলম্বন করে কিংবা না করে–এ কর্ম কি সহজ?
তবেই দেখো সোম, পৃথিবীতে অধিকাংশ লোকই এ যাবৎ কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে যে, উপস্থিত আহির মনই শক্তিশালী, তাকে না মেনে উপায় নেই। এমন কি তাদের একটা বনাফাইডি ডিপেস পর্যন্ত রয়েছে। শেষ বিচারের দিন যখন আহুর মজদা এদের শুধাবেন, তোমরা আহির মনের পক্ষ নিয়েছিলে কেন? উত্তরে তারা ক্ষীণকঠে বলবে–স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তখন তিনিই শক্তিমান–তখন, হুজুর, তিনিই ছিলেন শক্তিশালী, তাঁকে না মেনে উপায় ছিল কি? এটা কি খবু সদুত্তর? কেন, ভেবে দেখো, গ্রামের জুলুমবাজ জমিদারের ভয়ে যখন প্রজারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তখন তুমি কি সব সময় ধর্মের শোলোক কপচাও?
কিন্তু আমার জীবনে এ দর্শনের প্রয়োগ কোথায়?
পৃথিবীর সর্বত্র প্রাচীন শাস্ত্রেই আছে, অতি পূর্বযুগে নাকি একবার এক বিরাট বন্যা হয়েছিল; প্রাচীন আসিরীয় বাবিলনীয় প্রস্তরগাত্রে সে ঘটনার কথা খোদাই করা আছে, বাইবেলে তার বর্ণনা আছে, তোমাদের শও আছে কেশব তখন মীন-শরীর ধরে বেদ বাঁচিয়েছিলেন, অর্থাৎ সে বন্যায় তোমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ভেসে যায়নি, কোনো এক মহাপুরুষ তার শ্রেষ্ঠতম জিনিস বাঁচাতে পেরেছিলেন।
এই বন্যা নিয়ে একটি আধা খ্রীশ্চানী আধা-মুসলমানী গল্প আছে।
সেই বন্যা আসার পূর্বে জেহোভা তখনকার দিনের পয়গম্বর নূহকে ডেকে বললেন, বন্যায় সব ভেসে যাবে, তুমি একটা নৌকো বানিয়ে তাতে পৃথিবীর সব গাছ, ফুলের বীজ এবং যত প্রকারের প্রাণী এক এক জোড়া করে রেখো। বন্যার পর তাই দিয়ে পৃথিবী আবার আবাদ করবে। সাবধান কিছু যেন খোয়া না যায়।
নূহ তাই করলেন, কিন্তু বন্যার পর দেখেন কী, ইঁদুরে তাঁর আঙুরের বীজ খেয়ে ফেলেছে। আঙুর ফলের রাজা। গোজামিল দিয়ে সে ফলটা হারিয়ে যাওয়ার কেচ্ছা তিনি চাপা দিতে পারবেন না। ভারি বিপদে পড়লেন।
ওদিকে কিন্তু হুঁশিয়ার শয়তানও সব মাল এক-এক প্রস্ত করে রেখেছিল। সে তখন নুহকে তার বাঁচানো আঙুরের বীজ দেবার প্রস্তাব করলে–তার বীজ তো আর ইঁদুর শয়তানি করে খেতে পারে না অবশ্য কুমতলব নিয়ে। নূহের মনেও ধোকা ছিল, কিন্তু তিনি তখন নিরুপায়–বে-আঙুর দুনিয়া নিয়ে তিনি আল্লাকে মুখ দেখাবেন কী করে?