পাদ্রী যে ও-রেলির সঙ্গে জমে গেলেন তার অন্য কারণও আছে।
ও-রেলির থানার কাছেই পাদ্রীদের ইস্কুল। চাকরিতে ঢোকার দিন দশেক পরে ও-রেলি লক্ষ্য করল ইস্কুলে কতগুলো সায়েব-মেমের বাচ্চাও ঘোরাঘুরি করছে, কিন্তু দুর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না আসলে এরা ঠিক কী?
ইনসপেক্টর সোমকে ডেকে পাঠিয়ে বললে, সোম?
ইয়েস স্যর।
নো; আমাকে ‘স্যর’ ‘স্যর’ করো না।
নো, স্যর।
ফের স্যর?
ইয়েস স্য—
বাচ্চাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে সায়েব শুধাল, এরা কারা।
সোম চুপ করে রইল।
ও-রেলি বলল, দেখ সোম, তুমি আমার সহকর্মী। তুমি যা জান আমাকে খোলাখুলি বললে আমি এখানে কাজ করব কী করে, আর তুমিই বা আমার সাহায্য পাবে কী করে?
আজ্ঞে, এরা ইয়োরেশিয়ন।
ভালো করে খুলে বলো।
এরা দোআঁশলা; এদের অধিকাংশ চা বাগান থেকে এসেছে। এদের বাপ—
থামলে কেন?
–চবাগানের সায়েব আর মা-এই, এই, যাদের বলে কুলী রমণী।
ও-রেলি থ মেরে সব কিছু শুনল। তারপর অনেকক্ষণ ভেবে নিয়ে শুধাল, তা এদের সম্বন্ধে আমাকে কেউ কিছু বলেনি কেন, এমন কি পাদ্রী সায়েব পর্যন্ত না?
সোম বললে, এদের নিয়ে খাস ইংরেজদের লজ্জার অন্ত নেই, তাই এরা তাদের ঘেন্না করে। পাদ্রী সায়েব ভালো মানুষ, তাই নিয়ে ওঁর দুঃখ হওয়ারই কথা। বোধ হয়, আপনাকে ভালো করে না চিনে কোনো কিছু বলতে চাননি।
সেদিনই থানার থেকে ফেরার সময় ও-রেলি সোজা পাদ্রীর টিলা গেল। পাত্রীকে সে কী বলেছিল জানা নেই। তবে পাদ্রী-টিলার ব্যাডমিন্টন ক্লাবের প্রথম খাস ইংরেজ সদস্য ও-রেলি–অবশ্য পাদ্রী সায়েবদের বাদ দিয়ে–সে কথাটা ক্লাবের মিনিট বুকে সগর্বে সানন্দে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
খবর শুনে এস, ডি, ও, প্লমার ও-রেলিকে বললেন, গো স্লো।
ও-রেলি তর্ক জোড়েনি, তবে এ বিষয়ে তার মনের গতি কোন দিকে সেটা জানিয়ে দিতে কসুর করেনি।
রায়বাহাদুর খবরটা শুনে বললেন, নাঃ, ছোঁড়াটাকে তো ভালো বলেই মনে হচ্ছে। তবে না আখেরে ডোবে। পাদ্রী-টিলার কোনো একটা উপকা ঠুড়িকে বিয়ে করলেই চিত্তির।
আর ইস্কুলের ছোঁড়ারা তো ওর নাম দিয়ে ছড়া বানিয়েছিল,
ও-রেলি, কোথায় গেলি?
সাহেব মনে শুধিয়ে উত্তর শুনে ড্যাম গ্রাড।
তারপর হাত-পা ছুঁড়ে আবৃত্তি করলে,
O’ Mary, go and call the cattle
Home,
Call the cattle home,
Across the sands of Dee.’
আমাকে ঐ ক্যাটলদের একটা মনে করেছ বুঝি? তাই সই, আমি না হয় তোমাদের দেবতা হোলি কাওই হলুম।
.
০৩.
এক বৎসর হয়ে গিয়েছে! ও-রেলিকে মধুগঞ্জ যে ক্রিকেট ম্যাচের মত লুফে নিয়েছিল সেই থেকে সে শহরের ছেলে-বুড়োর বুকে গোজা-ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহ্যানুযায়ী তাকে ড্রপ করা হয়নি।
ইতিমধ্যে ভর বর্ষায় মধুগঞ্জের জলে সাড়ম্বরে নৌকা বাচ হয়ে গেল। বিলেত তার নৌকা বাচ নিয়ে যতই বড়ফাট্টাই করুক না কেন পূর্ব বাঙলার নৌকাবাচের তুলনায় সে লাফালাফি বাচ্চাদের কাগজের নৌকা ভাসানোর মত। ও-রেলি উল্লাসে বে-এক্তেয়ার। নৌকবাচের আইন-কানুন সোমের কাছ থেকে তিন মিনিটে রপ্ত করে বন্দুক কাঁধে করে উঠল মোটর বোটে। সোমকে বললে, তুমি এগিয়ে যাও আমার লঞ্চ নিয়ে ওদিকের শেষ সীমানায়, সেখানে যেন কোনো বদমাইশি না হয়। আমি এদিক সামলাব–এখানেই তো জেতার গোল?
সোম বললে, সায়েব, নৌকা-বাচের ফাউল আর তারপর বৈঠে দিয়ে মাথা ফাটাফাটির ঠ্যালায় ফি বছর এ-দিনটায় ভাবি চাকরি রিজাইন দেব। আজ তুমি আমায় বাঁচালে।
সায়েব বললে, তুমি কুছ পরোয়া করো না সোম; ফাউল বাঁচাতে গিয়ে খুনজখম আমিই করব। ইউ গো রাইট অ্যাহেড।
তারপর ও-রেলি বন্দুক দেগে রেসের স্টার্ট দিলে, পিছনে পিছনে মোটর বোট হেঁকে ফাউল সামলালে, উল্লাসে চিৎকার করে ঘন ঘন গ্র্যাণ্ড গ্র্যাণ্ড, ও হাউ গ্র্যাণ্ড হুঙ্কার ছাড়লে, কমজোর নৌকাগুলোকে চীয়ার আপ করলে আর সর্বশেষে প্রাইজের পাঠা, কলসী সকলের সঙ্গে হ্যাঁণ্ডশেক করে করে স্বহস্তে বিতরণ করলে। মাথা ফাটাফাটি যে হল না তার জন্য সোম আর বাইচ-ওলাদের অভিনন্দন জানালে।
সর্বশেষে সোম খুশিতে ডগমগ হয়ে বিজয়ী নৌকার গলুইয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলে, আসছে বছর যে নৌকা জিতবে সে পাবে হুজুর ও-রেলির পিতার নামে দেওয়া মাইকেল শীল্ড’। পুব বাঙলায় নৌকোবাচে এই প্রথম শীড় কম কথা নয়, আপনারা ভেবে দেখুন। আর সে শীল্ড লম্বায় তিন হাত হবে, হুজুরের কাছ থেকে সেটা আমি জেনে নিয়েছি। তার মানে পুব বাঙলার যে-কোনো ফুটবল শীল্ড তার তুলনায় ছোড় আচ্ছা পোলাডা। হুজুর শীল্ড কী ধরনের হবে সেটা আমায় বলতে বারণ করেছিলেন; আমি সে আদেশ অমান্য করেছি। কাল আমার চাকরি যাবে। তা যাক! এখন আপনারা বলুন,
থ্রী চিয়ারস ফর ও-রেলি
হিপ হিপ হুররে।
সে কী হুঙ্কারে হিপ, হিপ্! গাঁয়ের লোক এ ধরনের স্কুল রসিকতা বোঝে। তার উপর তাদের আনন্দ, দু দিনের চ্যাংড়া ফুটবল খেলার পাতলা দাপাদাপিকে তারা আজ হারিয়েছে। তাদের শীলড আসছে বছর থেকে সব ফুটবল শীল্ডের কান মলে দেবে।
ক্লাবের যে দু-একটি পাঁড় ইংরেজ কালা আদমিদের রেস দেখতে আসেননি তারা পর্যন্ত হুঙ্কার শুনে আঙুল দিয়ে কান বন্ধ করে বলেছিলেন, ও-রেলি ইজ গন্ কমপ্লীটলি নেটিভ।
অসম্ভব নয়। কিন্তু সেদিন শীল্ড ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে, যদি ও-রেলি গা-ঢাকা না দিত তবে পঞ্চাশখানা গায়ের লোক তাকে লিচ করত।