ভারতবর্ষে একদিন আমাদের প্রাধান্য আর থাকবে না, এ জিনিসটা আমার কল্পনার বাইরে নয়, কিন্তু আমরা জনির কাছে পরাজিত হব এবং ফলে আমরা জর্মন হুনদের তবেতে আসতে পারি, এ জিনিসটার কল্পনাও আমি করতে পারিনে। এ লড়াই জেতার, জন্য ভারতে শাস্তি গৌণ-মুখ্য,ভারতকে এই যুদ্ধে আমাদের হয়ে লড়ানো। ও-রেলি এ কাজটি তার এলাকায় অবিশ্বাস্যরূপে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। তার কার্যপস্থা ও সরলতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
তাই আমাদের সকলের কর্তব্য তাকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করা।
গতবার যখন তার সঙ্গে দেখা হয়, তখন তার পরিবারের কথা উঠেছিল। আমার প্রশ্নের সামান্যতম উত্তর না দিয়ে সে আমার দিকে যেভাবে তাকালে তাতে আমার মনে হল, এই বিষয় নিয়ে তার মনের কোণে এক গভীর বেদনা লুকানো আছে। আমার মনে হল, তার সম্বন্ধে আমরা যে-সব গুজব শুনেছি, সেগুলোর কিছুটা তার কানে। পৌচেছে এবং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই অসম্ভব জেনে চুপ করে সব আপবাদ সয়ে নিয়েছে।
হয়তো এটা বিচক্ষণের কর্ম। কিন্তু আমার মনে হল, এ বিষয়ে আমাদেরও কর্তব্যবোধ থাকা দরকার। যে মানুষ তার সম্বন্ধে জঘন্য অপবাদ সহ্য করেও আপন দেশের জন্য অম্লানমুখে অবিশ্রাম খেটে যাচ্ছে এবং খাটছে কাদের জন্য? যারা তার বিরুদ্ধে গুজব রটিয়েছে। তাদেরই জন্য-তার মনের জ্বালা লাঘব করার জন্য যদি আমরা আমাদের কড়ে আঙ্গুলটিও না তুলি, তবে আমরা যে নুন খেয়েছি তার উপযুক্ত সই। আর যদি আমাদের প্রফেশনের কথা তুলি তবে বলব, তুমি আমি পুলিশ; অসৎকে সাজা দেওয়া যেমন আমাদের কর্তব্য, সজ্জনকে অন্যায় আক্রমণ থেকে রক্ষা করা আমাদের ততোধিক কর্তব্য– ভারতীয় পুলিশ এ কথা ভুলে গিয়েছে।
আমি তাই স্থির করলুম, ও-রেলিকে না জানিয়ে তার স্ত্রীর অনুসন্ধান করে সত্য খবর মধুগঞ্জের ইউরোপীয় সমাজকে গোচর করাব। এবং তারপরও কারো বিষ-জিভ যদি লকলকানি আরম্ভ করে, তবে রাস্কেলটাকে মধুগঞ্জের ক্লাবহাউসের সিঁরিতে চাবকে দেব।
মেবল্ এবং তার বাচ্চা কোন মাসে বিলেত গিয়েছিল সে খবর বের করে আমি বোম্বাই, মাদ্রাজ, কলকাতা, কলম্বো এমন কি চাটগার বন্দরের সব প্যাসেঞ্জার লিস্ট তন্ন তন্ন অনুসন্ধান করেও তাদের নাম পেলুম না।
ও-রেলিকে সরিতে নাকি মেবল্দের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল সব কটা ইউরোপীয় হোটেলে অনুসন্ধান করেও ওদের নাম পাওয়া গেল না, অথচ ও-রেলির নাম সাভয় হোটেলের রেজিস্ট্রিতে রয়েছে।
ভারতবর্ষের হিল স্টেশনে কোনো ইউরোপীয় রমণীর পক্ষে নাম ভাড়িয়ে বেশী দিন। কাটানো প্রায় অসম্ভব, ছদ্ম নামে ছদ্ম পাসপোর্ট নিয়ে বিলেত যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।
সবদিক যখন ব্ল্যাঙ্ক বেরল তখন আমি মেদের বাটলারটার অনুসন্ধান করলুম সিংহলে তার গ্রামে। খবর এল সাত বৎসর ধরে সে গ্রামে ফেরেনি।
তাই আমি বড় সমস্যায় পড়েছি।
তুমি কি মধুগঞ্জে অত্যন্ত সাবধানে এ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে কোন্ পথে এগোতে হবে, সে সম্বন্ধে কিছু হদিস দিতে পার?
মনে রেখো, আমি এ যবাৎ সব অনুসন্ধান করেছি অতিশয় গোপনে, এবং বেশির ভাগ নিজে নিজেই পাছে ও-রেলি খবর পেয়ে মর্মাহত হয় যে, আমিও মধুগঞ্জের বক্সওয়ালাদের* মতো কচুটে। তুমিও সাবধানে কাজ করবে। আমাদের উদ্দেশ্য ও-রেলিকে মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্ত করা। সে-কর্মে সফলতা নাও পেতে পারি, কিন্তু তাকে আরো দুঃখ দেওয়া অত্যন্ত গহিত হবে।
সুভেচ্ছাসহ
ডাড্নি।
[* টী-চেস্ট বা চায়ের বাক্স নিয়ে কারবার করে বলে চা-বাগিচার সায়েবদের অবজ্ঞার্থ অন্য ইংরেজ নাম দিয়েছে বক্সওয়ালা। হিন্দী ‘ওয়ালা’ প্রত্যয় ব্যবহার করার অর্থ যে তারা হাফ-নেটিভ। ]
.
ঠিক সাতদিন পর বড় সায়েব ভীনের কাছ থেকে একখানি ছোট চিঠি পেলেন।
যতদূর সম্ভব শীঘ্র এখানে আসুন; সব আলোচনা মুখোমুখী হওয়ার প্রয়োজন।
বড় সায়েব খবর দিয়ে মধুগঞ্জে পৌঁছলেন। মোটরেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? ডীন উত্তর না দিয়ে শুধু ড্রাইভারের দিকে আঙুল দেখালে।
রাত্রে ডিনারের পর চাকরদের বিদায় দিয়ে ডীন বড় সাহেবকে তার স্টোর রুমের তালা খুলে ভিতরে নিয়ে গেল।
সায়েব দেখলেন, টুকরো টুকরো হাড়ে জোড়া তিনটি কঙ্কাল। একটা বড়, একটা মাঝারি, আরেকটা ছোট শিশুর।
তালা বন্ধ করে দুজনে বারান্দায় ফিরে এলেন। বড় সায়েব একটা নির্জলা বড় হুইস্কি খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
কোথায় পেলে?
বাগানে লিচুগাছের তলা খুঁড়ে।
কী করে সন্দেহ হ’ল?
ডীন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, আপনার চিঠি থেকে আমি দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছই যে, মেব্ল্দের কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আমি অবিশ্বাস্য জিনিসে বিশ্বাস করে আপন অনুসন্ধান আরম্ভ করলুম বরঞ্চ বলতে পারেন শেষ করলুম।
এ বাংলায় প্রথম দু রাত্রে আমি যে ত্রিমূর্তি দেখেছিলুম, সেগুলো আমার মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। যে গাছতলায় ছায়ামূর্তিগুলো হঠাৎ মিলিয়ে যায়, সে গাছটাকেও আমি স্পষ্ট মনে রেখেছিলুম। আপনার সব তল্লাসীই যখন নিষ্ফল হ’ল, তখন আমি যে কাজ করলুম সেটা শুনলে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে আমার গুরুরা হাসবেন। কিন্তু যে জিনিস আমি স্পষ্ট দেখেছি, যার সম্বন্ধে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই, সে জিনিস স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের কাছে আপনার কাছে-যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, আমার কাছে তাই বিশ্বাস্য সেই আমার খেই।