রাত একটার সময় ডীন ফিরে এল। বড় সায়েবকে নিতান্ত একা-একা ডিনার খেতে হ’ল বলে আবার দুঃখ প্রকাশ করলে।
বড় সাহেব সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, মিসেস ও-রেলি এখন কোথায় তুমি জান?
ভীন হেসে বললে, কেন? আপনিও কিছু শুনেছেন নাকি?
না তো। আমি শুনেছি, তিনি বিলেতে না মসুরিতে সে কথা কেউ জানে না। আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকল।
উনি বললে ঠেকারই কথা। কিন্তু এ নিয়ে কারো কানো কৌতূহল নেই। এর পিছনে আবার একটুখানি কেলেঙ্কারি কেচ্ছা রয়েছে। মেবল্ এখান থেকে সরে পড়াতে কেচ্ছাটি প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে।
তারপর ডীন ক্লাবে যা-কিছু শুনেছিল সে কথা তাকে সংক্ষেপে জানিয়ে বললে, পাছে আমি ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝতে পেরে এলোপাতাড়ি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, তাই মাদামপুরের সায়েক এ অঞ্চলে তিনিই মুরুব্রি-আমাকে এখানে আসার দিনই সমস্ত কথা খুলে বলে ইঙ্গিত করেন যে, এ ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করে কোনো লাভ নেই, ক্ষতিরই সম্ভাবনা। আমিও তাকে বলেছি, ব্রাদার অফিসারের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ারে আমি কনসার্নড নই।
বড় সায়েব বললেন, ঠিক বলেছে?
আরো পাঁচ রকমের কথা হ’ল বিশেষ করে লাড়াই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। দুজনেই ইয়র্কশায়ারের লোক, কাজেই দুজনারই পরিচিত অনেক লোকের প্রমোশন, জখম, বাহাদুরি, মৃত্যু নিয়ে অনেক সুখ-দুঃখ প্রকাশ করা হল।
রাত প্রায় একটার সময় বড় সায়েব শেষ ক্রেম দ্য আঁৎ খেয়ে উঠলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ বললেন, কই হে, তোমার ত্রিমূর্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না?
ডীন যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে বললেন, আপনি বাগদাদের কাজীর গল্প জানেন?
বেমক্কা হঠাৎ কাজীর গল্প কেন উপস্থিত হ’ল তার হদিস না পেয়ে বড় সায়েব বললেন, না তো!
ডীন বললে, মুর্গী খেতে খেতে কাজী বাবুর্চীকে শুধালেন, মুর্গীর আরেকটা ঠ্যাং কোথায়? বাবুর্চী বললে, মুর্গীটার ছিল মাত্র একটা ঠ্যাং। কাজী বললেন, একঠ্যাঙী মুর্গী কেউ কখনো দেখেনি। বাবুর্চী বললে, বিস্তর হয়, সে দেখিয়ে দেবে। তারপর শীতকালে এক দিন আঙিনায় একটা মুৰ্গী এক ঠ্যাং পালকের ভিতর খুঁজে দাঁড়িয়েছিল বাবুর্চী কাজীকে দেখিয়ে দিল একঠ্যাঙী মুর্গী। কাজী দিলেন জোর হাততালি। মুর্গী দুসরা ঠ্যাং বের কর ছুটে পালাল। কাজী বললেন, ঐ তো দুসরা ঠ্যাং। বাবুর্চী বললে, সেদিন খাওয়ার সময় তিনি হাত তালি দিলে দুসরা ঠাং-ও বেরোত।
বড় সায়েব বললেন, উত্তম গল্প, কিন্তু–
ডীন বললে, এতে আবার কিন্তু কী? আপনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন কম হুইস্কি খেতে-ত্রিমূর্তি হুইস্কি চোখে দেখেছিলাম কি না। আপনি যদি আচ্ছা করে আজ হুইস্কি খেতেন, তবে তার-ই হাততালিতে ত্রিমূর্তি বেরিয়ে আসতো। অথচ সায়েব খেয়েছিল পাঁচটা ব্রা বরা।
মনে মনে ভাবলেন, ছোকরা তুখোড়। বাইরে হেসে বললেন, আচ্ছা, আসচ্ছে বারে না হয়, ম্যাকবেথের তিন ডাইনির স্মরণে তিন বোতল খেয়ে ত্রিমূর্তিকে ইনভোক করা যাবে।
ডীন বললে–থ্রাইস ওথ-তিন সত্যি।
.
১৩.
লড়াইয়ের জন্য টাকা তোলার মতলবে ইংরেজ নানা ফন্দি-ফিকির চালালে–তারই একটা ‘আওয়ার ডে’, পুক-বাঙলার এই প্রথম ফ্ল্যাগ ডে। নেটিভরা বিদ্রূপ করে আওয়ার ডে-কে নাম দিল আওর দে অর্থাৎ অরো দে। ওদিকে ভারতবাসীদের কাছ থেকে এ দুঃসংবাদ আর লুকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না যে, ইংরেজ ক্রমাগতই লড়াই হারছে। চর্তুদিকে অভাব অনটনের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজের গৌরবও কমে যাওয়াতে পুব-বাঙালায় আরম্ভ হ’ল বাজার লুট। ইংরেজ ভয় পেয়ে গেল যে, একবার যদি এ অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেটা ঠেকানো সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
দেখা গেল, ও-রেলির এলাকায় কোনো বাজারে লুট হয়নি। আই জি, গেলেন ঐ এলাকা পরিদর্শন করতে আর ও-রেলির কাছ থেকে সলাপরামর্শ নিতে।
ও-রেলির বাংলোয় বসে বসে আলাপচারি করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল দেখে সে সায়েবকে পটলোক খেয়ে যেতে বললে।
খেতে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ আরম্ভ হ’ল। বড় সায়েবের পরিবারও বিলেতে, তাই নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অবধি নেই, তবে সাত্বনা এই যে, তার স্ত্রী লড়াইয়ের কাজে যোগ দিয়েছেন আর বড় মেয়ে তো নার্স হয়ে ফ্রান্সে গিয়েছে।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সায়েব বললেন, লড়াইয়ে যে শুধু মানুষ জখম হয় আর মরে সেইটেই তো শেষ কথা নয়, কত পরিবার যে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তার কি কোনো স্টাটিসটিকস কেউ নেয়? তোমার বউ বাচ্চা কি রকম আছে?
ভালোই।
চিঠিপত্র ঠিকমতো পাচ্ছ তো।
হু। তারপর বলল, ওসব কথা বাদ দিন। আমি আমার মনকে আদপেই বিলেতমুখো হতে দিইনে। যতটা পারি কাজকর্মে ডুব মেরে থাকি।
বড় সায়েব বললেন, সরি। কিছু মনে কোরোনা ও-রেলি। আমি পরের পারিবারিক সুখ-দুঃখের কথা সচরাচর জিজ্ঞেস করি নি। নিজের দুশ্চিন্তারই আমার অবসান নেই।
ও-রেলি চুপ করে রইল।
মাস দুইপর বড় সায়েব ভীনকে চিঠি লিখলেন,
প্রিয় ডীন,
আমি বড় সমস্যায় পড়ে তোমাকে চিঠি লিখছি।
প্রায় দুমাস হল আমি রাধাপুর মফঃস্বল যাই। সেখানকার অবস্থা খুব সন্তোষজনক সে খবর তুমি জান–তার জন্য রেলিকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে হয়, সে কথাও তোমার অজানা নয়। দেশে যে সে শান্তিরক্ষা করতে পেরেছে, সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা নয়, আমি মুগ্ধ হয়েছি অন্য কারণে।