ক্লাব ভাঙল অনেক রাত্রে,পরদিন কাইজারের খড়ের মূর্তি পোড়াবার সুব্যবস্থা করে। বেয়ারারা তাই নিয়ে নিজেদের ভিতর বিস্তর হাসাহাসি করলে। সায়েবদের বড়ফাট্টাই যে কী বেহদ বেশরম ফাবেনে সে-কথা তারা লড়াই লাগাবার কয়েক মাস পরেই টের পেয়ে গিয়েছিল। ওদিকে আবার তাদের যে-সব ভাই-বোনদের সাতজন্মে কখনো লড়াই দেখেনি তারা যেতে আরম্ভ করল ইরাকে। তাই নিয়ে পূর্ব বাঙলায় গান পর্যন্ত রচনা হয়ে গেল। সেপাই ফিরে এসেছে মেসপট থেকে দেশে; বউ জিজ্ঞেস করছে,
মিয়া, গেছলায় যে বসরায়
দেখছনি দালান?
ছোট ছোট সেপাইগুলি লাল কুর্তি গায়
হাঁটু পানিৎ ল্যামা তার
পিস্তত মারা যায়
মিয়া গেছলায় যে বসরায়, মিয়া গে (সোম)।
এ গীতে তবু বরঞ্চ গ্রাম্য মেয়ের সরলতা আর কল্পনাশক্তির খানিকটা বিকাশ পেয়েছে, কিন্তু সায়েবদের ছেলেমানুষি কত চরমে পৌঁছে গিয়েছে তার প্রমাণ বেয়ারাগুলো পেল যেদিন মধুগঞ্জের পাগলা চেঁচিয়ে গান ধরলে,
মরি, রাই, রাই, রাই,
জর্মনিরে ধরে এনে,
হামনি বাজাই।
এ গানের না আছে মাথা না আছে কাঁথা-পাগলা জগাইয়ের গানে কখনো থাকতও না-অথচ সায়েবরা গান শুনে ভাবলেন জগাই জনির কান খুব করে মলে দিচ্ছে। পাগলকে ডেকে এনে ক্লাবে তার নৃত্যসম্বলিত গান শোনা হ’ল, প্রচুর বকশিশ দেওয়া হ’ল, এবং তাকে একটি মেডেল দেওয়া যায় কি না সে সম্বন্ধে আলোচনা হল।
‘বাঙাল’ গাছে ফলে না, বাঙালের চাষ পূর্ব বাঙলার একচেটে নয়, তাই সায়েবদের বাঙালপনা দেখে বাঙাল বেয়ারাগুলো হাসলে জোর একপেট আর পাগলা জগাইকে খেতাব দিলে জঙ্গীলাট।
রাত্রে আই জি’র নিমন্ত্রণ ছিল ভীনের বাংলোয়।
সূপ শেষ হতে না হতেই ডি, এম-এর বাংলো থেকে জরুরী খবর এল স্বদেশীদের আড্ডায় বোমা ফেটে দুজন মারা গিয়েছে-ডীন যেন তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। ডীন তাদের অভিসম্পাত দিতে দিতে খানা ছেড়ে উর্দি চড়ালে।
আই জি, বাঙালা ভাষা বেশ শিখে গিয়েছিলেন। একা খানা খাওয়ার একঘেয়েমি কাটাবার জন্য বাটলারের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন। এককালে বড়লোকদের যদি শখ হত ছোট লোকদের সঙ্গে গল্প করার তবে তারা ডেকে পাঠাতেন চন্দ্ৰবৈদ্যকে-মুখচন্দ্রটিকে বিচক্ষণ বৈদ্যের মতো খাফসুরত করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নাপিত হুজুরকে দুনিয়ার নানা খবর নানা গুজব শুনিয়ে ওয়াকিফহাল করে তুলত। বিলেতে এখনো ও কর্মটি করে বাটলার এবং খানদানি সায়েবদের যারাই দেশী ভাষা শিখতে সক্ষম হয়েছেন তারাই এ দেশে সেই রেওয়াজটি চালু রেখেছেন।
সায়েবের মতির গতি ধরতে পেরে খয়রুম্পা আলোচনা আরম্ভ করলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে সায়েব সায় দিলেন, তারপর ভরসা দিলেন লড়াই শিগগিরই খতম হয়ে যাবে-সায়েব শুধু হু বললেন খয়রুল্লা কথার মোড় ফিরিয়ে বললে; দিশী লোক বসরা থেকে বেশ দু পয়সা বাড়িতে পাঠাচ্ছে-সায়েব আনন্দ প্রকাশ করলেন।
থানার শেষ পদ ছিল পনিরে রান্না আস্ত আণ্ডা। বহুকাল ধরে বিলেত থেকে পনির আসছে না বলে বড় সায়েব তাই নিয়ে প্রশংসা ও বিস্ময় প্রকাশ করলেন। খয়রুল্লা দেমাক করে জানালে এ পনির বিলেতি নয়, এ জিনিস তৈরী হয় মৈমনসিংহের অষ্টগ্রামে। বিদেশী পনির যখন এ-দেশে পাওয়া যেত সেই আমলেই ও-রেলি সায়েবের মেম দিশী পনিরের সন্ধান পেয়ে তাই দিয়ে এই নুতন সেভারি আবিষ্কার করেন। খয়রুলার মতে তার মতো পাকা রাধুনী এদেশে কখনো আসেনি। তখন জয়সুর্যের মেট তার কাছ থেকে সে এ জিনিসটে বানাতে শিখেছে।
বড় সায়েব জানতেন মিসেস ও-রেলি বিলেতে। তবু কথার পিঠে কথা বলার জন্য আপন মনেই যেন শুধালেন, তা মেম সায়েব তো এখন বিলেতে?
খয়রুল একটুখানি চুপ করে থেকে বললে, বোধ হয় তাই। তবে সঠিক কেউ বলতে পারে না। মীরপুর বাগিচার বেয়ারা বলছিল তিনি মসুরি না সিমলে কোথায় যেন।
এবারে সায়েব একটুখানি আশ্চর্য হলেন। বললেন, সে কী, হে? এই সামান্য খবরটাও সঠিক জান না?
খয়রুল্লার দিলে চোট লাগল। পুলিশ সাহেবেরে বেয়ারা হিসেবে জাতভাইদের ভিতর তার খুশ-নাম ছিল যে, সে দুনিয়ার সকলের নাড়ীনক্ষত্র জানে, তাকে কি না সায়েব স্পষ্ট ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন সে একটা আস্ত উজবুক, দুনিয়ার কোন খবর রাখে না। তার চেয়ে যদি তিনি তাকে খবর দিতেন যে সে এদিকে জানে না, ওদিকে কিন্তু তার বিবি বিধবা হয়ে গিয়েছেন, তা হলেও তার কলিজা এতখানি ঘায়েল হত না। তাই ইজ্জত বাঁচাবার জন্য বললে, সঠিক খবর তো দিতে পারেন শুধু ও-রেলি সায়েবই। তা, তিনি তো কারো সঙ্গে কখনো কথা বলেন না, তাকে শুধাতে যাবে কে?
বড় সায়েব খানদানী ঘরের ছেলে। সায়েব-মেমদের নিয়ে চাকর-নফরের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলতে চান না; আলোচনাটা ওদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে বললেন, ঠিক বলেছ।
খয়রুলাও পেটে আক্কেল ধরে। সায়েব যদি বা কথার মোড় ফেরালেন, সে তার সামনে খাড়া করে দিলে একখানা নিরেট পাচিল।
বললে, সে বহু মেহনত করে ক্লাব থেকে কিঞ্চিৎ উত্তম কফি যোগাড় করে এনেছে,পারকুলেটরে সেটা চড়িয়ে রেখেছে, সায়েব যদি একটু মর্জি করেন?
ডিনার শেষ হলেপর খয়রুলা বললে, সে সায়েবকে সার্কিট হাউসে পৌঁছিয়ে দেবার জন্য নিচের তলায় অপেক্ষা করবে। কফি লিকার-সিগার তিনটিই উত্তম শ্রেণীর ছিল বলে সায়েব তদণ্ডেই ডেরা ভাঙবার কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না। জানালেন, তিনি একাই সার্কিট হাউস যেতে পারবেন।