মধুগঞ্জের যেখানেই যাও না কেন উত্তরদিকে তাকালে দেখতে পাবে, কালো নদী, সবুজ মাঠ আর তার পর নীল পাহাড়। আর সেই পাহাড় বেয়ে নেমে এসেছে কত শত রূপালী ঝরনা। দূর থেকে মনে হয়, নীল ধাতুর উপর রূপোর বিদ্রী মিনার কাজ।
এ পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে না–এ পাহাড় বলে, যেখানে আছে সেইখানেই থাকো।
এ রকম পাহাড় বিলেতে প্রচুর আছে, শুধু গায়ে নেই মিনার কাজ আর সামনে নেই সবুজ মাঠ, কাজলধারার কালো জল।
তাই আইরিশম্যান ডেভিড ও-রেলি মধুগঞ্জে অ্যাসিসটেন্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ হয়ে আসামাত্রই জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেল।
.
০২.
প্রেমটা কিন্তু দু তরফাই হ’ল। ছোট্ট মহকুমার শহরটি ও-রেলিকে দেখে প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেললে।
তার প্রধান কারণ বুঝতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। ও-রেলি সত্যই সুপুরুষ। ইংরেজ বাঙালীর তুলনায় অনেক বেশী ঢ্যাঙা তার উপর এদেশে বেশীদিন বাস করলে কেউ হয়ে যায় দারুণ মোটা, কেউ বড় লিকলিকে, কারো বা নাক হয়ে যায় টকটকে লাল, কারো দেখা দেয় সাদা চামড়ার তলায় বেগনি রঙের মোটা মোটা শিরা উপশিরা। তারই মাঝখানে হঠাৎ যখন স্বাস্থ্যসবল আরেক ইংরেজ এসে দেখা দেয়–ইংরিজিতে যাকে বলে ফ্রেশ ফ্রম ক্রিসটিয়ান হোম্–তখন সে সুন্দর না হলে তাকে প্রিয়দর্শন বলে মনে হয়, রাজপুত্তুর না হলেও অন্তত কোটালপুত্তুরের খাতির পায়।
বয়স তার একুশ, জোর বাইশ। সায়েবদের ফরসা রঙ্ তো আছেই কিন্তু তার চুল খাঁটি বাঙালীর মতো মিশকালো আর তার সঙ্গে ঘননীল চোখ। এ জিনিসটে অসাধারণ; কারণ সায়েব-মেমদের চুল কালো হলে চোখও কালো, নিদেনপক্ষে বাদামী–আর চুল ব্লণ্ড হলে চোখ হয় নীল। আমাদের দেশেও যাদের রঙ ধবধবে ফরসা হয় তাদের চোখও সাধারণত একটুখানি কটা; তাই যখন তাদের চোখ মিশমিশে কালো হয় তখন যেন তাদের চেহারাতে একটা অদ্ভুত উজ্জ্বল্য দেখা দেয়। কালো চুল আর নীল চোখও সেই আকর্ষণী শক্তি ধরে।
মধুগঞ্জ যদিও ছোট শহর তবু ত রি বিলিতি ক্লাব এ অঞ্চলে বিখ্যাত। শহর থেকে বিশ মাইল দুরে যে স্টেশন সে পথের দুদিকে পড়ে বিস্তর চা-বাগান আর রোজ সন্ধ্যায় সে সব বাগান থেকে হেটিয়ে আসত ক্লাবের দিকে সায়েব-মেম আর তাদের আণ্ডাবাচ্চারা।
ফুটফুটে ক্লাব বাড়িটি। একদিকে লন টেনিসের কোট আর ভিতরে বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা–বিলিয়ার্ডের বল দেখে খানসামারা ক্লাবের নাম দিয়েছিল আণ্ডাঘর আর সেই থেকে এ অঞ্চলে ঐ নামই চালু হয়ে যায়।
এ সম্পর্কে মুরুব্বি রায়বাহাদুর কাশীশ্বর চক্রবর্তীরও একটা ‘অনবদ্য অবদান’ আছে। ক্লাব তখন সবেমাত্র খুলেছে। সায়েব-মেমরা ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে টুকটাক করে টেনিস খেলছেন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রায়বাহাদুর ভীত নয়নে একটিবার সেদিকে তাকালেন। সে সন্ধ্যায় পাশার আড্ডায় রায়বাহাদুর গম্ভীর কণ্ঠে সবাইকে বললেন, দেখলে হে কাণ্ডখানা, সায়েবরা নিজেদের জন্য রেখেছে একখানা মোলায়েম খেলা, ধাক্কাধাকি মারামারি নেই–যে যার আপন কোটে দাঁড়িয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছে। আর তোমাদের মত কালো-আদমিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে একটা কালো ফুটবল। তার পিছনে লাগিয়েছে বাইশটা নেটিভকে–মরো গুঁতোগুঁতি করে, আপোসে মাথা ফাটাফাটি করে। আর দেখছ, সাহেবদের যদি বা কেউ তোমাদের খেলায় আসে তবে সে মাঠের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বাজায় গোরা রায়ের বাঁশি তার গায়ে আঁচড়টি লাগাবার জো নেই।
পাশা খেলোয়াড়রা একবাক্যে স্বীকার করলেন, এত বড় একটা দার্শনিক তত্ত্বের আবিষ্কার একমাত্র রায়বাহাদুরেরই সম্ভবে, তদুপরি তিনি ব্রাহ্মসন্তানও বটেন!
সেই রায়বাহাদুরের সপ্তম দর্শনের বেলুনটি ফুটো করে চুপসে দিয়ে নাম করে ফেললে বিদেশী ও-রেলি। চার্জ নেবার তিনদিন পরেই দেখা গেল, সে ইস্কুলের ছোঁড়াদের সঙ্গে ফুটবলে দমাদ্দম কিক লাগাচ্ছে আর এদেশের ভিজে মাঠে খেলার অভ্যাস নেই বলে হাসিমুখে আছাড় খেল বার তিরিশেক।
রায়বাহাদুর বললেন, ব্যাটা বদ্ধ-পাগল নয়,–মুক্ত–পাগল।
পাশা খেলোয়াড়রা কান দিলেন না। পুলিশের বড় সায়েব ছোঁড়াদের নিয়ে ধেই ধেই করলে অভিভাবকদের আনন্দিত হওয়ারই কথা। কিন্তু এসব পরের কেচ্ছা।
ক্লাব জয় করেছিল ও-রেলি–প্রথম দিনই টেনিস খেলায় জিতে নয়, হেরে গিয়ে। মাদামপুর চা-বাগিচায় বড় সায়েব এ অঞ্চলের টেনিস চেম্পিয়ান। পয়লা সেট ও-রেলি জিতল; কারণ সে বিলেত থেকে সঙ্গে এনেছে টেনিস খেলার এক নূতন ঢঙ-মিডকোর্ট গেম আর বড় সায়েব খেলেন সেই বেজলাইনে দাঁড়িয়ে আদ্যিকালের কুটুস-কাটুস। অথচ পরের দু সেটে ও-রেলি হেরে গেলদাবার ভাষায় বলতে গেলে অবশ্যি গজচক্র কিংবা অশ্বচক্র খেল না বটে। আনাড়ি দর্শকেরা ভাবলে বড় সায়েব প্রথম সেটে সুতো ছাড়ছিলেন; জউরীর বিলক্ষণ টের পেয়ে গেল, ও-রেলি প্রথম দিনেই ওভার চালাক, বাউণ্ডার’ হিসেবে বদনাম কিনতে চায়নি। মেমেরা তো অজ্ঞান যদিও হারলে তবু কী খেলাটাই না দেখালে, মাস্ট বি দি হীট, ইউ নো ফ্রেশ ফ্রম হোম ইত্যাদি। বড় সায়েবও খুশি। সবাইকে বলে বেড়ালেন, ছোকরা আমার চেয়ে ঢের ভালো খেলে, তবে কি না, বুঝলে তো, আমার বুড়ো হাড়, হেঁ হেঁ, অফ কোর্স!
পরদিনই দেখা গেল, ও-রেলি বুড়ো পাদ্রী সায়েব রেভরেণ্ড চার্লস ফ্রেডারিক জোনসকে পর্যন্ত বগলদাবা করে নিয়ে চলেছে আণ্ডা-ঘরের দিকে। বুড়ো পাদ্রী অতিশয় নীতিবাগীশ লোক, অবরে সবরে ক্লাবে এলে নির্দোষ বিলিয়ার্ডকে পর্যন্ত ব্যসনে শামিল করে দিয়ে এক কোণে বসে সেই অজ ওয়েলসের দেড় মাসের পুরনো খবরের কাগজ পড়তেন কিংবা বাচ্চাদের সঙ্গে কানামাছি খেলতেন। ও-রেলির পাল্লায় পড়ে ধর্মপ্রাণ পাদ্রীর পর্যন্ত চরিত্রদোষ ঘটল। দেখা গেল, পাদ্রী এখন প্রায়ই ক্লাবে এসে ও-রেলির সঙ্গে এক প্রস্ত বিলিয়ার্ড খেলে সন্ধ্যের পর তার সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে শহরের বাইরে ও-রেলির বাঙলোর দিকে চলেছেন।