অন্ধকারে মানুষ যেমন নিজকে সাহস দেবার জন্য শিশ দেয়, পেট্রোমাক্সটাও ঠিক তেমনি মৃদু একটানা শ-শব্দ করে যাচ্ছে আর ভয়ে মরছে হঠাৎ কখন অজানাতে অন্ধকার তার লম্বা আঙুল দিয়ে বাতির চাবিতে দম দিয়ে তার দম বন্ধ করে দেবে।
ভীন চাকর বাকরকে বিদেয় দিয়ে পিস্তল কোলে নিয়ে বসেছে সিঁড়ির দিকে মুখ করে। টিপয়ের উপর রিস্টওয়াচ।
রাত ঘনিয়ে এল। আগের রাত্রে ভোরের দিকে চোখের দু পাতা জুড়েছিল মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, দিন কেটেছে নানা কাজের ঠেলায় এখন বারে বারে ঘুম পাচ্ছিল, কিন্তু আজ তো সর্বচৈতন্য কোলম্যান মাস্টার্ডের মতো তীক্ষ্ণ সজাগ রাখতে হবে। সে আজ আদৌ মদ খায়নি, জাস্ট টু বি অন ১০০% সেফ সাইড।
ঘড়িতে বারোটা বেজেছে। ডীন ভাবলে এবারে আরো সজাগ হতে হবে। রুমালটা ভিজিয়ে এনে চোখে বোলাবার জন্য এদিক ওদিক খুঁজছে এমন সময় হঠাৎ দেখে সেই ত্রিমূর্তি বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। ডীন মন স্থির করে রেখেছিল দেখামাত্র পিস্তল হাতে ছুটে গিয়ে ওদের ঠ্যাকাবে কিন্তু কাজের বেলায় এক মুহূর্ত দেরী হয়ে গেল ছুটে গিয়ে যখন নিচের বারান্দায় নামল তখন ত্রিমুর্তি বাগানের বড় জামগাছটার কাছে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে দেখে তখনো বারোটা-অর্থাৎ সকালে দম দেওয়া হয়নি।
এবারে ভীন ছুটোছুটি করলে না। মাই গড বলে চাপরাশীর টুলে বসে পড়ল-ভীষণ বিপাকে না পড়লে ইংরেজ মাই গড়’ বলে না।
অনেকক্ষণ পর সে বেডরুমে ঢুকল। ক্লান্তিতে নিদ্রা-জাগরণে মেশা আসৃপ্তির ভিতর দিয়ে রাত কাটল।
সকাল বেলা সোম এল।
তিনটে নয়, দুটো খুন।
সেদিকে খেয়াল না করে ডীন শুধালেন, সোম, এ বাড়ি ভূতরে?
সোম বললে, জানি নে স্যার।
তুমি ভূত মান?
নো, স্যার।
তাহলে এ বাড়ি কিংবা যে কোনো বাড়ি ভূতরে হয় কী করে?
জানি নে স্যার।
ডীন বলতে যাচ্ছিল, তুমি একটা গবেট, আর তোমার প্যারা বস একটা আস্ত গাড়ল না হলে তোমাকে শার্লক হোমসের মতো ঠাওরালে কেন? ঠিকই তো, বোকাকে বুদ্ধিমান মনে করা, এ যেন গাধা দেখে বলা এটা ঘোড়া। যে একথা বলে সে শুধু গাধা চেনে না তা নয়, ঘোড়াও চেনে না।
তারপর ডীন আরো পাকাপাকিভাবে আটঘাট বেঁধে ত্রিমূর্তির জন্য ত্রিরাত্রি অপেক্ষা করল, কিন্তু তাকে নিরাশ হতে হ’ল।
সপ্তাহের শেষে আই জি-কে রিপোর্ট লেখার সময় ডীন এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে লিখব কি লিখবনা করে করে কী করে যে লিখে ফেললে নিজেই বুঝতে পারলে না। ভাবলে ওটা কেটে ফেলি-সে বিলক্ষণ জানত, ইংরেজ এ সব কেচ্ছা নিয়ে নির্মম হাসাহাসি করে কিন্তু তাহলে আবার নুতন করে রিপোর্ট লিখতে হয়, আর লেখালেখির ব্যাপারেই পুলিশ বাবাজীরা হামেশাই একটুখানি কাহিল।
যাগকে বলে শেষটায় পয়লা পাঠই পাঠিয়ে দিলে।
তিন দিন বাদে উত্তর এল। তার শেষ ছত্র, ড্রিক লেস স্পিরিট।
ভীন খাঙ্গা হয়ে বললে, ড্যাম দি স্পিরিট।
.
১২.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয় করে ইংরেজ সগর্বে তার ইতিহাস রচনা করেছে। যুদ্ধে হেরে জর্মন সলজ্জ ইতিহাস লিখেছে। দুটোর কোনোটা থেকেই প্রকৃত সত্য জানবার উপায় নেই। তাই মনে হয়, ইংরেজের ইতিহাসটা যদি জর্মন লিখতে এবং জর্মনেরটা ইংরেজ তাহলেও হয়ত খানিকটে সত্যের কাছে যাবার উপায় থাকত। কিংবা যদি ভারতবাসী লিখত কারণ সে যে এ বাবদে অনেকখানি নিরক্ষেপ সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
তাই চা বাগানের আশেপাশের, বিশেষ করে মধুগঞ্জের লোক বিলক্ষণ জানে ইংরেজ তার শৌর্যবীর্য নিয়ে যতই লম্ফঝম্ফ করুক না কেন চা-বাগিচার সায়েবদের ভিতর লেগে গিয়েছিল ধুন্ধুমার। তার ইতিহাস লেখা হয়নি, কোনো কালে হবেও না।
হাতিম-তাই না সিন্দাবাদ কোন এক দেশে গিয়েছিলেন যেখানে মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে বুড়ো হয়ে কিংবা অসুখ-বিসুখ করে মরে না। প্রতি সন্ধ্যেয় সবাই এক জায়গায় ম্লান মুখে বসে কিসের যেন অপেক্ষা করে,আর হঠাৎ এক গম্ভীর ডাক শুনে ওদের একজন লাফ দিয়ে উঠে দূর দিগন্তে পালিয়ে যায়, কেউ তার পিছু নেয় না, সেও আর কোনো দিন ফিরে আসে না।
চা বাগিচার বড় মেজো ছোট বেবাক সায়েব রোজ সন্ধ্যেয় ক্লাবে বসে প্রতীক্ষা করেন,লড়াইয়ে যাবার জন্য বিলেত থেকে কোন দিন কার ডাক পড়ে। এবং কাজের বেলা দেখা গেল হাতিম-তাই-এর গল্পের লোকগুলোর মত এরা পত্রপাঠ বিলেতের দিকে ছুট দেন না- এদের অনেকেই আছেন ডাক এড়াবার তালে।
সিভিল সার্জেন ইংরেজ তার উপর কট্টর সাম্রাজ্যবাদী, সাটিফিকেট পাওয়া অসম্ভব, কাজেই এদের উর্বর মস্তিষ্ক তখন লেগে যায় নূতন নূতন ফন্দি ফিকিরের অনুসন্ধানে। এক ভীত তো সাহস করে বাঁ হাতের কব্জিতে গুলি মেরে সেটাকে জখম করে লড়াই এড়ালে। মাদামপুর বিষ্ণুছড়া নিজেদের ভিতর লজ্জায় মাথা হেঁট করলেন।
তারই মাঝখানে কে যেন খবর এনে দিল ও-রেলি লড়ায়ে যাবার জন্য নিজের থেকে প্রস্তাব পেড়েছিল, কিন্তু ভারত সরকার রংরুটের অসুবিধা হবে তাকে যেতে দিল না, কারণ সে ইতিমধ্যেই জনপঞ্চাশেক বাঙালী ছোকরাকে করেছে এবং তার ভিতর গোটা পাঁচেক টেরেরিস্টও আছে।
ও-রেলি সম্বন্ধে আর সব কথা ক্লাব এক মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে একবাক্যে বললে, শাবাশ।
পুলিশের ক্লাবে আই জি. এসেছিলেন মধুগঞ্জে টুরে। ক্লাবে বসে ও-রেলির উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি শুনে নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রতি গর্ব অনুভব করলেন। তার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলতে না বলেই ক্লাবের নয়া-ঝুনা সব সদস্য দফে দফে তার গুণকীর্তন করলেন, এবং বিষ্ণুছড়ার ছোট মেমই বিগলিতা হলেন সবচেয়ে বেশী।