তিনটি মূর্তির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার পূর্বেই তারা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। ভীন শুধু দেখলে প্রথমটি দৈর্ঘ্যে মাঝারি, দ্বিতীয়টি ছোট এবং তৃতীয় টি বেশ লম্বা ব্যস আর কিছু না।
সম্বিতে ফিরে ডীন ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নামল। চর্তুদিকে ঘোরঘুটি অন্ধকার, নিচের তলায় ছাতা ল্যাম্প বেরায়া অনেকক্ষণ হ’ল নিবিয়ে দিয়েছে,উপরের তালার আলো সেখানে পৌঁছায় না। ডীন সদ্য বিলেত থেকে এসেছে- মফঃস্বলে টর্চের কী প্রয়োজন এখনো জানতে পারেনি। তার টর্চ নেই। ছুটে গেল গেটের কাছে; সেখানে রাস্তার ক্ষীণ আলোতে দেখলে, চর্তুদিক জনমানবশূন্য।
সাপ, চোর, শেয়াল দেখলে আমরা চীৎকার করে চাকর-বাকরদের ডাকি, কারণ আপন দেহ রক্ষার জন্য এদের উপর আমরা নির্ভর করেছি যুগ-যুগ ধরে। বিলেতের লোক কাজকর্ম চালাচ্ছেন বিন চাকরে বহুকাল ধরে। তাই সম্বিতে ফিরেও ডীন চেঁচামেচি আরম্ভ করলে না। ধীরে ধীরে বারান্দায় ফিরে আবার চেয়ারে বসল।
আকাশ-কুসুম কেউ কখনো দেখেনি সে শুদ্ধ কল্পনামাত্র। স্বপ্ন আমরা দেখি, কিন্তু তার পিছনে কোনো বাস্তবতা নেই। রুজু দেখে যখন সর্পভ্রম হয় তখন সে সর্প বাস্তব নয় বটে, কিন্তু ভ্রম কেটে যাবার পরও রুজুটিকে ধরতে-ছুঁতে পাই। ডীন যা দেখল সেটা এর কোনো পর্যায়েই পড়ে না। তাহলে কি সে বাস্তব জিনিস প্রত্যক্ষ করল? তাই বা কী করে হয়? বেডরুমে তো কারো থাকার কথা নয়-ডিনার শেষ হওয়ার পর চাকররা চলে গিয়েছিল, ও-রেলি যাওয়ার পর উপরের তলায় তো সে একেবারে একা বসে ছিল। তবে কি ওরা মেথরের দরজা দিয়ে বাথরুম বেডরুম হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল? ডীন চেক-আপ করে দেখলে মেথরের দরজা ডবল বল্টে বন্ধ।
তবে কি মদ্যপান? অসম্ভব। খেয়েছে মাত্র ছোট দু পেগ-তাও ডিনারের আগে। দু পেগে বঙ্গ-সন্তানেরই চিত্তচাঞ্চল্য হয় না-ও দিয়ে তো ইংরেজ কপালে তিলক কাটে।
ছুটোছুটি আর উত্তেজনায় ডীনের ঘুম ততক্ষণে ক্ষীন নয় লীন হয়ে গিয়েছে। বিছানায় ছটফট না করার চেয়ে বরঞ্চ চেয়ারে বসে প্রতীক্ষা করাই ভালো, যারা গেছে তারা ফিরে আসে কি না। পুলিসের লোক- প্রথম সম্বিতে ফেরা মাত্রই সে ঘড়ি দেখে নিয়েছিল। এরা বেরিয়েছিল ১২টা ৩০ এবং ৩৫-এর মাঝামাঝি। যদি তারা নিতান্তই ফেরে তবে তো ফিরবে ভোরের আলো ফোঁটাবার আগেই। ডীন পিস্তলটা সুটকেশ থেকে বের করে পেগ টেবিলের উপর রেখে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।
ঘণ্টা চারেক সিগারেট পোড়ানোর পর লুপ্ত ঘুম ফিরে এল কিন্তু যাদের জন্য এত অপেক্ষা তারা আর এল না।
সকাল বেলা বেয়ারা বেড-টী এনে দেখে সায়েব চেয়ারের উপরে বেঘোর ঘুমে কাতর। শেষ সিগারেট হাত থেকে পড়ে গিয়ে পেগ টেবিলের বার্নিস পুড়িয়ে দিয়েছে।
আরো একটু ক্ষতি হ’ল ভীনের। সেদিনই আণ্ডাঘরের বেয়ারা-মহলে রটে গেল, নুতন সায়েব বোতলবাসী-পিয়সী। কেউ প্রশ্ন পর্যন্ত করল না, যে বেয়ারা চা এনেছিল সে বোতল খালি পেয়েছিল না ভর্তি।
.
সকাল হতে না হতেই ভিজিটারদের ঠ্যাল্যা। তাদের সঙ্গে লৌকিকতা করতে করতে ডীন ভাবছে আগের রাত্রের কথা। দিনের আলো প্রখর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের কাছে রাত্রের প্রহেলিকা হাসির বিষয় হয়ে দাঁড়াল। স্বপ্নের ঘোরে কিংবা ঘুমের জড়তায় কী দেখতে কী দেখেছে তাই নিয়ে সে ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি করলে-ইস্তেক পিস্তল বের করলে। কী আশ্চর্য! এদেশে একটানা বিশ বছর কাটানোর পর অসহ্য গরম আর সুদীর্ঘ বর্ষার ঠ্যালায় ইংরেজদের মাথায় ছিট জন্মায়-দেশে ফিরে গিয়ে তার ধকল কাটায় পুডিং দিয়ে খানা আরম্ভ করে আর সুপ দিয়ে শেষ করে। তাদেরই একজন, ভীনের এক মামাকে নিয়ে সে কতই না ঠাট্টামশকরা করেছে,আর বেচারী মামা কিছু না বলতে পেড়ে শুধু হম হম করেছে। আর তার নিজের সেই অবস্থা এই প্রথম রাত্রেই। পিস্তল ও চায় স্বপ্নের পেট ফুটো করতে? তার হ’ল কী?
এমন সময় সোম এসে খবর দিলে, কাল রাত্রে তের-সতীতে জলে ডাকাতির খবর এসেছে। বোধ হয় গোটা তিনেক খুনও হয়েছে। সে অকুস্থানে যাচ্ছে।
ইংরেজের বাচ্চা নিজেকে এতক্ষনে সংযত করতে শিখেছে। কোনো চাঞ্চল্য না। দেখিয়ে শুধালেন রাত কটায় কাণ্ডটা ঘটেছে? কী জানি, ঠিক বলা যাচ্ছে না দুপুর কিংবা শেষ রাতে।
সোম চলে গেল।
টু হেল–অর্থাৎ চুলোয় যাগগে বলে ডীন মধুগঞ্জের ম্যাপ মেলে গেজেটিয়ার খুলে পড়তে বসল।
কিন্তু চুলোয় যাগগে বললেই যদি সব আপদ চুলোয় যেত তাহলে গোটা পৃথিবীটাকেই হামেহাল নরককুণ্ডের মতো জ্বালিয়ে রাখতে হত। সন্ধ্যে হতে না হতেই দিনের বেলার হেসে উড়িয়ে দেওয়া আপদ ভীনের মনের ভিতর কিন্তু কিন্তু করে ইতি-উতি করতে লাগল। ডিনারে বসে মনে হ’ল কাল রাত্রের ঘটনা স্বপ্ন নয়,মায়া নয়, মতিভ্রম নয় ইংরিজিতে ভাবতে গেলে ইলুশন, ডিলুশন, হ্যাঁলুসিনেশন কিছুই নয়। প্রেসটিভিজিটেশনও নয় কারণ ঐ রাত সাড়ে চব্বিশটার সময় তাকে ম্যাজিক দেখিয়ে বোকা বানাতে যাবে কোন ভাড়?
বাগানে আম-জাম-লিচুর অন্ধকার ক্রমেই যেন বারান্দার দিকে গুঁড়িগুড়ি এগিয়ে আসছে। প্রতিপদ আকাশের মেঘময় অন্ধকার নেবে আসছে নিচের দিকে, দুই অন্ধকারের ভিতর কি যেন গোপন যোগসাজস রয়েছে।
সেই নিরেট জমে-ওঠা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে গাছপালার মধ্যে সূক্ষ্ম–অতি সুক্ষ্ম ছিদ্র করে কাজলধারার উপরদিয়ে-বেয়ে যাওয়া নৌকার ক্ষীণ প্রদীপের আলোক মাঝে মাঝে এসে পৌঁছচ্ছে বাংলোর দিকে। কিন্তু সে আলোক চোখে পড়ে ঐ দিকে অনেকক্ষণ ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে। সে আলো তখন যেন চোখকে আরো কানা করে দেয়। চতুর্দিকের অন্ধকার যে কতখানি পুঞ্জীভূত নীরদ্ধ তখনই ঠিক ঠিক বোঝা যায়।