পার্টি শেষ হতেই ও-রেলি নিয়ে গেল ভীনকে তার বাঙলোয়। ডিনার খেয়ে ও-রেলি তার ডেরা তুলে মোটরে যাবে স্টেশন, আর ডীন খাটাবে তার বাঙলোতে আপন ডেরা। চাকরি-জগতে সরকারী বাসা সম্বন্ধে এ-ই হচ্ছে এদেশে আইন অবশ্য সাদা কালিতে লেখা।
ডীন সবেমাত্র বিলেত থেকে এসেছে, তার উপর সে বকরবকর করতে ভালোবাসে এককালে ও-রেলি গালগল্প জমাতে কিছুমাত্র কম ওস্তাদ ছিল না কাজেই সে একটানা গল্প বলে যেতে লাগল। ও-রেলিই ব্যবস্থাটা মনঃপূত হ’ল, তাই যদি ডীন দু-একবার ভদ্রতার খাতিরে তাকে কথা বলবার চেষ্টা করলে সে তাতে সাড়া না দিয়ে উলটে দু-একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তাকে আবার বকরবকর করাতে তাতিয়ে দিলে।
ও-রেলির মালপত্র মোটরে তোলা হয়ে গিয়েছে–এখন তার ওঠবার সময় হ’ল দেখে ডীন শুধালে, এখানে ভালো করে কাজ চালাবার জন্য আপনি টিপস দেবেন কি? আমার তাতে উপকার হবে।
ও-রেলি বললে, সে কথা যে আমি ভাবিনি তা নয় এবং দেবার মতো টিপস থাকলে আমি অনেক আগেই এ প্রস্তাব পাড়তাম–ভীন বললে,সরি আমি বড্ড বেশী কথা বলি,-না?
ও-রেলি বললে, নটেটোল। চুপ করে অন্যের কথা শুনলেই অপর পক্ষকে বেশী চেনা যায় তা নয়। অনেক সময় নীজে কথা বলে বলে অন্যের উপর কী প্রতিক্রিয়া। হয়-তার মাথা নাড়াতে, হা না বলাতে, কোন প্রসঙ্গে সে ইনটরেস্ট নিচ্ছে, কোনটাতে নিচ্ছে না-তাই দিয়ে মানুষ চেনা যায় অনেক বেশী। তার উপর সমস্তক্ষণ কথা বললে অন্য পক্ষ কোন প্রশ্ন শুধাবার সুযোগ পায় না যে প্রস্তাব তোলার ইচ্ছে নেই, সেটা বেশ এড়িয়ে যাওয়া যায়। মধুগঞ্জ লোক্যাল বোর্ড চেয়ারম্যান এব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। অপ্রিয় কথা ওঠবার সম্ভাবনা দেখলেই তিনি পাখি শিকার, ৯০ সালের ভূমিকম্প,আর গিরের ফিতে না ইঞ্চির ফিতে ভালো, এসব নিয়ে এমন গল্প জোড়েন যে, তার ঘর থেকে বেরনাই তখন মুশকিল হয়ে ওঠে।
সে কথা যাক। আমি মাত্র একটি টিপ দেব। আপনার আপিসের সো-তার সঙ্গে তো আপনার আলাপ হয়েছে বড় খাঁটি আর বুদ্ধিমান লোক। আপনি তো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে অনেক পদ্ধতি শিখে এসেছেন,সেগুলোর কটা এখানে কাজে খাটবে জানিনে, তবে একথা আপনাকে বলতে পারি সোম যেখানে ফেল মারে, সেখানে করার মতো বড় কিছু একটা থাকে না। অন্তত আমি কিছু পারিনি।
ডীন একটুখানি অবিশ্বাসের সুরে বললে, দেখে তো কিন্তু বুদ্ধ বলে মনে হয়।
ও-রেলি হেসে বললে, প্রিসাইসলি। ঐ তার একটা মস্ত রেস্ত। কিন্তু এদেশে অল দ্যাট স্টিকস ইজ নট রটন ফিশ ঝলমল করলেই সোনা নয় হচ্ছে তার উল্টো প্রবাদ। বর্মাতে একরমক ফল আছে, তার গন্ধ পচা নর্দমার মতো, কিন্তু একবার সে ফল যে খেয়েছে,তার ঐ ফলের জন্য নেশা হয় আফিমের চেয়েও বেশী। সোম ঐ বর্মী-ফল।
তাহলে গুড নাইট।
গুড নাইট।
৩. খ্রীষ্টালয় থেকে সদ্যাগত
১১.
খ্রীষ্টালয় থেকে সদ্যাগত–ফ্রেশ ফ্রম ক্রিষ্টিয়ান হোম-ওলাদের এদেশে এসে বায়নাক্কার অন্ত থাকে না। এটা নেই, ওটা চাই, সেটা কোথায়-সুবো-শাম লেগেই আছে। তবু যত বর উন্নাসিকই হোক না কেন, পুলিস সায়েবের বাঙলোটি কিছুমাত্র ফেলনা নয়।
ডিনার খেয়ে দুজনাই এসে বসেছিল চওড়া বারন্দায়। বস্তুত এ বারান্দাটাই বাড়ির সবচেয়ে আরামের জায়গা। ও-রেলি চলে যাওয়ার পর ডীন বেয়ারাকে দিয়ে সিগারেটের তাজা টী খুলে আরাম করে গা এলিয়ে বসল। লণ্ডন ছেড়েছে অবধি জাহাজে ট্রনে সর্বত্র হৈ হুল্লোড়ের ভিতর দিয়ে তার সময় কেটেছে, দুদণ্ড নিজের মনে নূতন নূতন অভিজ্ঞতার জমা-খরচ মিলিয়ে নিতে পারেনি-অথচ গুণীরাই জানেন যারা কথা কয় বিস্তর তারাই নির্জনতা খোঁজে শান্তজনের চেয়ে বেশী।
পেট্রোমান্স জ্বলছে। তার আলো বারান্দার বাইরের অন্ধকার কিন্তু ফুটো করতে পারছে না। এদিকে আবার বর্ষার গুমোট। আকাশ থমথম করছে। গাছগুলো অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া পর্যন্ত ডাইনে বাঁয়ে, উপরে নীচে কোনো দিকে যেতে চায় না। এ অবস্থায় মুখের ধোয়া দিয়ে খাসা রিং বানানো যায়। মুখ থেকে বেরিয়েই রিংগুলো একটার পিছনে আরেকটা সারি বেঁধে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে। থাকে। তখন সিগারেট খেকোরা আর সিগারেটের নেশা করে না। রিঙের নেশায় পিলপিল করে চক্করের পুর চক্কর বের করতে থাকে।
ব্যাচেলাররা দেরিতে শুতে যায়, এ-কথা সাবই জানে, আর তামাক-খোররা যায়। আরো দেরিতে। আরেকটা খেয়েই উঠছি, আরেকটা খেয়েই উঠব’ করে করে ঘুমে সিগারেটে যখন লড়াই বেশ জমে ওঠে তখন অনেক সময় রেফরি লড়াইয়ে ক্ষান্ত দিয়ে ঘুমের শরণ নেয়, সিগারেটও চটে গিয়ে কার্পেট মশারি পোড়ায়।
ভীনের চোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছে, ডান হাত চেয়ারের হাত থেকে খসে ঝুলে পড়ছে, টিলে আঙুল থেকে সিগারেটটা খসি-খসি করছে, এমন সময়–
এমন সময় ভীন দেখে তিনটি প্রাণী-মূর্তী কী বলি?-বেডরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় নেমে গেল। সে বসে ছিল বারান্দার এক প্রান্তে, বেডরুম অন্য প্রান্তে-সিঁড়ি তারই গা ঘেঁষে।
ভীনের চোখে কাঁচা ঘুমের ছানি। তার ভিতর দিয়ে সবকিছু যেন অবছা-আবছা, যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে দেখা দিল, কিংবা যেন, সিনেমার পর্দায় দিলে ফোকাসের ছবি।