বিষ্ণুছড়া বুঝলেন, সায়েবের একটু চড়েছে বয়স হয়েছে কি না, আস্পেই একটু কেমন যেন হয়ে যান না হলে স্কার্ফ, সুয়েটারের কথা বলবেন কেন? ও বস্তু মধুগঞ্জে পরবে কে? সাদা চোখে এ ভুলটা করতেন না, হয়তো বলতেন টিটের বেকন, সার্ডিন। চেপে গিয়ে বললেন, কলকাতার ও শীর সঙ্গে নর্থ ক্লাবে দেখা হয়েছিল, সে বললে, মেব্ল্ আর তার বাচ্চাকে সে মাস তিনেক আগে দেখেছে মসুরিতে, সঙ্গে ও-রেলি। তোমার মনে আছে কিনা জানিনে, ও-রেলি তখন ছুটি নিয়ে মসুরি গিয়েছিল।
এবারে মাদামপুর হা হা করে হেসে উঠলেন, কে বলেছে? ও শী? কটা মেবল্ আর কটা ডেভিড দেখিছিল জিজ্ঞেস করেনি? ওতো সকালে খায় কড়া হর্স-নেক, দুপুরে জিন, সন্ধ্যায় রম আর রাত্রে হুইস্কি। সন্ধ্যায় দেখে থাকলে নিশ্চই দুটো,আর রাত্রে দেখে থাকলে চারটে রেলি দেখেছে কটা মসুরি দেখেছে সেকথা জিজ্ঞেস করেছিলে কি?
বিষ্ণুছড়া বুঝলেন, এখন আর কথা-কাটাকাটি করে কোনো লাভ নেই। তাই বললেন, সোমও বলছিল মেবা লণ্ডনে আছে।
মাদামপুর আশ্চর্য হয়ে শুধালেন, সোম বললে? আশ্চর্য! ওতো কখনো কোনো খবর কাউকে দেয় না। মধুগঞ্জের বানান জিজ্ঞেস করলে ভাবখানা করে যেন সরকারী টপ সিক্রেট। আমি তাকে একদিন বলেছিলুম, ‘ফাইন ওয়েদার, সোম’ মুখখানা করলে যেন আলীপুরের আবহাওয়া দফতর থেকে রির্পোট না এলে সে ঐ একসট্রি মলি কনফিডিয়েনশেল খবর কমফার্ম করতে প্রস্তুত নয়। তাই বলছি সোম যখন বলেছে তখন ওটা বাইবেল বাক্য।
কিন্তু বিষ্ণুছড়ারই ভুল। হঠাৎ চেয়ারখানা তার কাছে টেনে এনে মাদামপুর একটুখানি সামনের দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় অত্যন্ত সাদা গলায় গম্ভীরভাবে বললেন, কোথায় আছে, কোথায় নেই, ওসব খোঁচাখুঁচি করতে গেলে আবার সেই ধামাচাপা ডার্টি লিনেন বেড়িয়ে পড়বে। তাতে ইয়োরোপীয়ন কমিউনিটির কী লাভ? বরঞ্চ ক্ষতিরই সম্ভাবনা। নো নিউজই যদি হয়, তবে জান তো প্রবাদ, নো নিউজ ইজ গুড নিউজ। বিষ্ণুছড়া অভয় পেয়ে বললেন, বিশেষ করে সোমের কথাই পাকি খবর। কিন্তু ও-রেলিকে একটি বিদায়ভোজ দিতে হবেনা। ক্লাবে আসুক আর না-ই আসুক, চাদা তো ঠিক ঠিক দিয়ে গিয়েছে, এমন কি টেনিসের এস্ট্রাও। চ্যারিটি-ফ্যারিটির পয়সায়ও কামাই দেয়নি।
মাদামপুর বললেন, সাউণ্ড করে দেখতে পার। কিন্তু আসবে কি।
এ সম্বন্ধে মাদামপুর এবং বিষ্ণুছড়ার মনে সন্দেহ জাগা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ও-রেলি আসতে রাজি হল। তবে ইঙ্গিত করলে যে, ডিনারের বদলে মামুলি টি-পার্টি হলেই ভালো হয়। ক্লাব রাজী হ’ল।
ক্লাবের প্রায় সবাই সেদিন হাজিরা দিলেন। ও-রেলি সঙ্গে নিয়ে এল তার বদলী সমরসেট ভীনকে। চটপটে ছোকরা, সমস্তক্ষশ কথা কয় আর এক সিগারেট থেকে আরেক সিগারেট ধরিয়ে দেয়শলাইয়ের খর্চা বাঁচায়। রেলি ভীনকে ক্লাবের সঙ্গে সাড়ম্বর পরিচয় করিয়ে নিয়ে বললে, ইনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে খাশ তালিম নিয়ে তৈরি হয়ে এদেশে এসেছেন, মধুগঞ্জ এর সেবায় উপকৃত হবে।
গুজোব রটাতে ফিসফাস-গুজগাজ করতে ইংরেজ এবং বাঙালীতে কোনো তফাৎ নেই, কিন্তু যাকে নিয়ে এসব করা হয়, তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করাটা ইংরেজের অভ্যাস নয় এবং এটিকেটের খেলাফ। তাই মেব্ল্ সম্বন্ধে ও-রেলিকে মুখের উপর কেউ কোনো প্রশ্ন শুধালে না। একেবারে কোনো প্রকারের অনুসন্ধান না করাটা আবার মরুরিদের পক্ষে ভালো দেখায় না। তাই বুড়ো মাদামপুর ও ডি, এম, শ্রেণীর দু-একজন ও-রেলির পরিবারের খবর নিলেন, কোনো প্রকারের প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে, অর্থাৎ শুদু আশা প্রকাশ করলেন, মেরা বিলতে ভালো আছে নিশ্চয়ই। ও-রেলি ঘাড় নেড়ে সায় দিলে।
মোটের উপর পার্টিতে কোনরকমের অস্বস্তি কিংবা আড়ষ্টতার ভাব দেখা গেল না। ও-রেলি ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে কথা কইলে। বাঙলা দেশে তখন স্বদেশী আন্দোলন প্রায় সব শহরেই ছোট বড় দয়ের সৃষ্টি করেছে। কথাবার্তা হ’ল সেই সম্বন্ধেই বেশী। ও-রেলি আইরিশম্যান, তাই সে বুঝিয়ে বললে, এসব আন্দোলন নিমূল করা পুলিসের কর্ম নয়, বিলেতের পার্লামা যদি সময়োপযযাপী ব্যবস্থা অবলন না করেন, তবে সন্ত্রাসবাদ বাড়বে বৈ কমবে না। অবশ্য তার অর্থ এই নয়, পুলিস হাত পা গুটিয়ে বসে বসে বিড়ি ফুকবে-সে তার কর্তব্য করে যাবে, তবে তারও একটা সীমা আছে।
মাদামপুর এ বাবদে কট্টর। কিন্তু ও-রেলি তার বক্তব্য এমনভাবে গুছিয়ে বললে যে, তিনি পর্যন্ত বাগান ফেরার সময় বিষ্ণুছড়াকে বললেন, পিটি, ছোঁড়াটার পারিবারিক জীবন সুখের হ’ল না। ওকে কিন্তু দোষ দিয়ে লাভ নাই। ছেঁড়ার মাথাটা ঘাড়ের সঙ্গে ঠিকমত স্ক্র করাই আছে। আমি সত্যই প্রার্থনা করি, ও যেন জীবনে সুখী হয়।
বিষ্ণুছড়াও সায় দিয়ে বললেন, হোয়াই নট। ইট ইজনেভার টু লেট টু বিগিন এগে।
মীরপুরের মেম দরদী রমণী। তিনি ও-রেলিকে একবার এক লহমার তরে একেলা পেয়ে তার ডান হাত চেপে বলেছিলেন, ও-রেলি,তুমি আমার ছেলের বয়সী, তাই তোমাকে বলি, জীবনটা একেবারে বহু জিগলো ধাঁধার মতো প্রথমবারেই সব মেলাতে না পারলে নিরাশ হবার মতো কিছু নেই। তোমার উপর আমার আর্শীবাদ রইল।
ও-রেলি স্পষ্টই বিচলিত হয়েছিল। আধো-আধ্যে ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে কেটে পড়েছিল।