ও-রেলি বললে,না
তারপর একটু ভেবে নিয়ে, জিজ্ঞেস না করা সত্ত্বেত্ত বললে, বাটলার পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে সে দেশে যাবে। অনেককাল ছুটি নেয়নি বলছিল।
কণ্ঠে কিন্তু বিরক্তির সুর।
সোম না হয়ে আর কোনো নেটিভ হলে ভাবত, এই সাদা-মুখ-গুলোর মতিগতি বোঝা ভার, কিন্তু সোম মেলা ইংরেজ চরিয়েছে। সে অত সহজ সমাধানে সন্তুষ্ট নয়। বড় ভারী মন নিয়ে সোম বাড়ি ফিরল। ও-রেলিকে সে সত্যই ভালোবেসে ফেলেছিল।
সোনমুগ সরু চাল সুপারি ও পান
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখানা
গুড়ের পাটালি কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভাণ্ড ভালো রাই সরিষার তেল—
এই সব পর্বত প্রমাণ মালপত্র নিয়ে আমারা সফরে বেরই, আর সায়েবরা কি রকম মাত্র একটি সুটকেস হাতে নিয়েই গটমট করে গাড়িতে উঠে,তাই দেখে বাঙালীর ভারি ঈর্ষা হয়। কিন্তু ঐ সুটকেসটির ভিতরকার মালপত্র তৈরি করতে গিয়ে সায়েবদেরও হিমসিম খেতে হয়। মোকামে পৌঁছনোর পর বাঙালী যদি দেখে ধুতির অনটন তাহলে সে কারো কাছ থেকে ও জিনিসটে ধার নিয়ে পরতে পায়- এমনকি কুর্তাতেও খুব বেশী আটকায় না-কিন্তু সায়েবরা কোট-পাতলুন ধার নিয়ে পরতে পারে না, ফিট হ’ল কিনা সেটা মারাত্মক প্রশ্ন।
মেব্ল্কে তাই বাচ্চার কাপড়-জামা তৈরি করাতে বেশ বেগ পেতে হ’ল। ভূমধ্যসাগর অবধি আবহাওয়া গরম, মধুগঞ্জের জামা-কাপড়েই চলবে ।কিন্তু তারপরের জন্য যে গরম জিনিসের প্রয়োজন সেতো মধুগঞ্জে পাওয়া যায় না। তাই ফ্লানের, সার্জ, টুইড আনাতে হ’ল শিলঙ থেকে,আর আনাতে হ’ল শহরের বুড়ো খলিফাঁকে। তাই নিয়ে পড়ে রইল মেব্ল্ দিনের পর দিন, আর ও-রেলি-সুটকেস-হ্যাটকেসে সঁটতে লাগল জাহাজের লেবেল। যে বা যাবে কেবিনে তার এক রঙ, এবং যেটা যাবে স্টোররুমে তর অন্য রঙ এবং যেটা হাতে থাকবে তার জন্য কোনো লেবেলের প্রয়োজন নেই। এই রামধনুর রঙের প্যাঁচ ও-রেলি তো একবার মতিচ্ছন্ন হয়ে বাচ্চার পিঠে লেবেল লাগিয়েছিল আর কি।
বিদায়ের আগের সন্ধ্যায় জিনিসপত্র-ফিটফাট ছিমছাম হ’ল পরদিন ভোর ছটায় ও-রেলি মোটর হাঁকিয়ে সবাইকে কুড়ি মাইল দুরে স্টেশনে পেঁছিয়ে দেবে। চাকর বাকরদের বললে তারা যেন বাড়ি গিয়ে তাড়াতারি শুয়ে পড়ে,কারণ পরদিন ভোরবেলা এসে মালপত্র ওঠাতে তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। কম্পাউণ্ডে রইল শুধু বাটলার-অন্য চাকর-বাকরদের সেখানে রাত্রিবাসের কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
পরদিন ভোরের দিকে বৃষ্টি হ’ল। চাকর-বাকররা কোনোগতিকে ছটায় বাঙলো পৌঁছে দেখে সবাই চলেছে-গারাজ খালি, বাড়ি তালাবন্ধ। ও-রেলি সায়েবের সব কিছু তড়িঘড়ি ঝটপট, কাঁটায় কাঁটায়। চাকররা আন্দাজ করলে সামান্য পাঁচ মিনিট দেরিতে আসার জন্য তাদের একটু খানি বকুনি খেতে হবে।
সায়েব ফিরল বেশ বেলা গড়িয়ে যাবার পর। আরদালি আসমউ সায়েবের জন্য দুখানা কাটলিস আর আলুসেদ্ধ করে রেখেছিল, কিন্তু সে কিছু না খেয়ে সোজা দোতলায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সব কিছু শুনে রায়বাহাদুর কাশীশ্বর চক্রবর্তী বললেন, আহা, বেচারা, এবারে একদম একা পড়ে গেল।
তার জুনিয়ার তালেবুর রহমান বলেছেন, আমি ভাবছি অন্য কথা। বাচ্চাটা বিলেত গেল বাঘ হয়ে ফিরে আসবার জন্য। তখন লাগাবে নেটিভদের উপর জোর ডাণ্ডা।
মুল্লুকে থাকলে তাদের তরে দরদী হয়ে যেত, ছাতির খুন ঠাণ্ডা আর দিলও মোলায়েম মেরে যেত।
রায়বাহাদুর বললেন, সে কী কথা! ও-রেলির মত ভদ্রালোকের ছেলে কি কখনো বৈরীভাব নিতে পারে? কী বলো সোম? সোম বললে, আপনার ছেলের বিলেত যাওয়ার কী হল?
রায়বাহাদুর বললেন, জানেন ব্রাহ্মণী।
তালেবুর রহমান বললেন, সোম ভাবে সে একটা মস্ত ঘড়েল।
ক্লাবে হ’ল অন্য প্রতিক্রিয়া। প্রায় সবাই বললে, গেছে গেছে, আপদ গেছে। কেলেঙ্কারিটা তো চাপা পড়ল। এখন ক্লাবের ছেলে ও-রেলি ক্লাবে ফিরে এলেই হয়।
কিন্তু আরেকটি বৎসর কেটে গেল। ও-রেলি ক্লাবে এল না।
.
১০.
বাড়ির সামনের জ্যোতিমান এবং অন্ধকারে মানুষের তৃতীয় চক্ষুস্বরূপ ল্যাম্পপোস্ট সম্বন্ধেই যখন সে দুদিন বাদেই অচেতন হয়ে যায়, তখন অদৃশ্য ও-রেলিকে ক্লাব যে ভুলে যাবে, তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে। কিন্তু যেদিন খবর এল ও-রেলি মধুগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে গিয়েছে, সেদিন ক্লাবে তাঁর সম্বন্ধে আর-এক প্রস্ত আলোচনা করে নিলে।
মাদামপুর আর বিষ্ণুছড়াই প্ৰথম খবর পেলেন ডি, এম-এর কাছ থেকে।
মাদামপুর বললেন,’ভালই হল। যাচ্ছে ককসবাজার না কোথায়, সেখানে কেলেঙ্কারিটা হয়ত পেছয়নি এবং পেছলেও সেটা বাসি হয়ে গিয়েছে। ওখানে গিয়ে হয়তো পুয়োর ডেভিল আবার নর্মাল লাইফে ফিরে আসতে পারবে। আমি সত্যি তাকে বড্ড মিস করতুম।
বিষ্ণুছড়া চুপ করে রইলেন,ভালো মন্দ কিছু বললেন না।
মাদামপুর শুধালেন, কী হে, চুপ করে রইলে যে? হুইস্কি চড়েছে নাকি?
বিষ্ণুছড়া বললেন, সাতটা ছোটায়? আই লাইক দ্যাট-আপনিও যেমন!? তারপর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে খাড়া হয়ে বসে বললেন, আমি সে কথা ভাবছিনে। আমার কানে এসে সেদিন পৌঁছল, মেবা নাকি আদপেই ইংলণ্ড পৌঁছয়নি।
মাদামপুর বললেন, আমিও শুনেছি, কিন্তু তারা পৌঁছল কি না তার খবর দেবে। কে? মেবলের সঙ্গে ক্লাবের কারো তো এমন দহরম-মহরম ছিল না যে, বন্দর বন্দর থেকে পিকচার-পোস্ট কার্ড পাঠাবে আর লণ্ডন-পোছে কেবল। মোকামে পৌঁছে প্রতি মেলে স্কার্ফ, সুয়েটার আর গরম মোজা, প্যোর স্কটিশ উলে তৈরী। হোম মেড!