বাপ্তিস্ম-পরবের পর চার বৎসর কেটে গিয়েছে। এ চার বৎসর মেবল্ ডেভিডের কেটেছে তসবীর দানা কুড়োতে কুড়োতে না তুলোধুনো হয়ে হয়ে–তার খবর দেবে কে? কাজলধারা নদীর মত নিরবধি তাদের জীবনগতি সমুখ পানে ধেয়ে চলেছিল, না সামনের নীলপাথরী পাহাড়ের মত স্থাণু হয়ে পড়েছিল তাই বা বলবে কে? মধুগঞ্জ শুধু দেখল, যে বারান্দায় সায়েব আর মেম বসে থাকত, বাটলার রেকর্ডের পর রেকর্ড বদলে যেত সেখানে একটি চতুর্থ প্রাণী প্রথম দোলনায় শুয়ে তারপর পেরেম্বুলেটারে বসে এবং সর্বশেষে টলমল হয়ে হেঁটে হেঁটে বারাটাকে চঞ্চল করে তুলত। যেখানে আর দুটি প্রাণী–জয়সুর্যকে ধরলে কখনো বা তিনটি–আপন আপন আসনে ধ্যানমগ্ন সেখানে এই নুতন প্রাণীটির আনাগোনার অন্ত নেই। কখনো সে মেবলের কোলে মাথা গুঁজে দুটি খুদে হাত দিয়ে তার উরু জড়িয়ে ধরে, মে তার কালো চুলের ভিতর দিয়ে আঙুল চালিয়ে দেয়, কখনো সে ডেভিডের আস্তিন ধরে টানাটানি আরম্ভ করে, তখন সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর কখনো বা জয়সুর্যের গলা জড়িয়ে ধরে তার কাছ থেকে লেখা গান ধরত–
ক্-ক্-ক্-কেটি, হুয়েন দি ম্-ম্-ম্-মুন শাইনস্–
একমাত্র ওরই জীবনে এখনো তসবী, ধনুরী কেউই আসেনি। সময় কী বস্তু সে এখনো বোঝেনি-টেকোর ভয় নেই উকুনের।
বাচ্চা প্যাট্রিকের চতুর্থ জন্মদিনে ও-রেলিরা স্থির করলে মেবল্ বাচ্চাকে নিয়ে বিলেত চলে যাবে, সেখানে বাসা বেঁধে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করবে। মধুগঞ্জের ইস্কুল দিশীর কাছে অক্সফোর্ডসম হতে পারে, কিন্তু সায়েবের বাচ্চা যদি সেখানে ট্যাশ উচ্চারণ শেখে তবেই চিত্তির। বড় হয়ে সে বাপ-মাকে প্রতি সন্ধ্যায় অভিসম্পাত না দিয়ে উইস্কি-সোডা স্পর্শ করবে না, সে যে ইয়োরেশিয়ান নয়, সেকথা বোঝাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হবে,বোঝাবার মোকা না পেলে সেই মর্মে ডুবে মরতে হবে। টমাস কুক, অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস, আর দুনিয়ার যত জাহাজ কোম্পানীর ছবির বিজ্ঞাপন, চটি বই, জাহাজের টাইম-টেবিল ওবেলির বারান্দা ভরতি হয়ে গেল। হিন্দিতে বলে :
বাঘ কা ভাই বাঘেরা
কুপে পাঁচ তো কুদে তেরা
বাঘ যদি দেয় পাঁচ লম্ফ, তবে তার ভাই বাঘেরা মারে তেরাটা। বাঙলায় প্রবাদ ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। অর্থাৎ যাত্রী যদি কোম্পানিকে লেখে,আমি লণ্ডন যাব, তবে তারা যে শুধু ঐ জাহাজেরই খরওয়ালা চটি বইই পাঠায় তাই নয়, সঙ্গে পাঠায় আরেক হন্দর পথিক দিক-দর্শন–তাতে আছে নরওয়ের ফিয়োর্ডে যেতে হলে কোন জামাকাপড় অপরিহার্য, মধ্য আফ্রিকায় উট চড়তে হলে আগেভাগে ইনক্রোশন নিতে হয় কি না। ফলে এই পর্বতপ্রমাণ কাগজপত্রের মাঝখানে বিলাতগামী জাহাজের বিশল্যকরণী খুঁজে বের করা হনুমানের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। ও-রেলি সেই অষ্টাদশ পূর্বে উদয়াস্ত ডুব মেরে পরে রইল।
সোম এসেছিল একদিন সরকারী কাজে। কাগজপত্রের ডাঁই দেখে শুধালে, স্যার, গুষ্টিসুদ্ধ নর্থপোলে চললেন নাকি? এর চেয়ে অল্প দুলিল-দস্তাবেজ তো কিংবা শনিতে ভ্রমণ করে আসা যায়।
ও-রেলি এক তাড়া কাগজ সোমের দিকে ছুঁড়ে ফেলে বললে, মঙ্গল–শনির কথা বলতে পারিনে, কিন্তু নর্থপোলে যেতে হলে এসবের দরকার হয় না। সেখানে যাবার জন্যে কোনো স্টীমার-সার্ভিস নেই। আন্ত জাহাজ চার্টার করতে হয়। সেখানে ঠিক তার উলটো। কত সব অলটারনেটিভ দেখো। বোম্বাই থেকে জাহাজ ধরবে,না কলম্ব থেকে কিংবা মাদ্রাজ থেকে? পি, এণ্ড, ও, নেবে না মার্কিন জাহাজ, না জর্মন? ফরাসীও নিতে পারো–জাহাজগুলো বড় নোংরা কিন্তু রান্না ভারী চমৎকার। তুমি কি একটা প্রবাদ বলো না, দি ডোম ইজ ব্ল্যাইও ইন দি ব্যান্ডু-জাঙ্গল? আমার হয়েছে তাই।
বহুকাল পরে সায়েবের তাজ-দিল দেখে সোম খুশি হ’ল। বললে, তাহলে সায়েব, অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্ণইটদি বো ষ্টিং টুডে-অর্থাৎ সবচেয়ে সস্তা জাহাজ নিলেই হয়।
ও-রেলি বললে, দেখো সোম, আমাকে আর ধাপা দেবার চেষ্টা করো না। গোড়ার দিকে কিছু জানতুম না বলে তুমি তোমার আপন মাল গুড় ওড় ইণ্ডিয়ান উইজডম বলে পাচার করেছ বিস্তর। এখন আর সেটি চলছে না। আমার পনচা-টাণ্ট্রা, হিটোপডেস পড়া হয়ে গিয়েছে। ধনুর ছিলে খেতে গিয়ে তোমারই শেয়ালের কী হয়েছিল মনে আছে?
সোম ইস্কুলের ছেলেদের ভঙ্গীতে তড়াক করে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললে, খুব মনে আছে, স্যর! ছিলে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তা যাবে না? আপনারই তো বলেন, ডিম না ভেঙ্গে মমলেট বানানো যায় না।
ও-রেলি বললে,ডিম দিয়ে মামলেড কী করে হয় হে? মামলেড তো হয় কমলালেবুর খোসা দিয়ে।
আজ্ঞে মামলেড নয়, মমলেট?
ও! অমলেট!
আজ্ঞে না। অমলেট হয় বিলেতে, বিলিতি ডিম দিয়ে। দিশী ডিম হয় মমলেট। তা যখন মামলেড্ মমলেটের কথাই উঠল, ওসব তৈরী করেন মেয়েরা। জাহাজ বাছাইয়ের ভার মেমসাহেবের হাতে ছেড়ে দিলে হয় না?
ও-রেলির মুখ কঠিন হল। সোমের দৃষ্টি এড়াল না।
সুরসিক যদি বদমেজাজী আর খামখেয়ালী হয়, তবে তাকে নিয়ে বড় বিপদ। যন্ত্র চট করে বেসুরো হয়ে যায় আর তার বিকৃত স্বর সব কিছু বরবাদ করে দেয়।
ও-রেলির হুঃ বীণাবাদ্যের মাঝখানে প্যাচার কণ্ঠের মত শোনাল।
সোম বুঝলে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে ঢোঁড়া বেরিয়েছে। এইখানেই থামা উচিত, না হলে হয়তো কেউটে বেরুবে। কিন্তু হঠাৎ থেমে গিয়ে বিদায় নিলে সেটা হবে আরো বেতালা। একটুখানি ইতি উতি করে শুধালে, আপনি পোর্টে ওদের সী অফ করতে যাচ্ছেন তো?