ও-রেলি পরিবার বাদ দিলে মধুগঞ্জে আছে মাত্র একজন ক্যাথলিক–বাটলার জয়সুর্য। ও-রেলিদের মতই এক্কেবারে খাঁটি। ওবেলি বললে, সেই হবে ধাপ। শুনে পাদ্রী সায়েব পর্যন্ত অনেক যদি অনেক কিন্তু অনেক ইউ নো হোয়াট আই মীন অনকে বাট অফ কোর্স বলে ইতি-উতি করে মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন, এমনকি, কলকাতা থেকে তার পরিচিত ভুদ্র ক্যাথলিক আনাবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু, ও-রেলি একদম নেই-আঁকড়া,বলে ধর্মের চোখে সব ক্যাথলিকই বরাবর–পোপ যা, জয়সূর্যও তা।
ও-রেলির কথার কোনো জমা-খরচ পাওয়া গেল না। বাপ্তিস্মর বেলায় সে দিলদরিয়া-হেরেটিক প্রটেস্টানটই সই অথচ ধর্বাপের বেলা সে কট্টর-ক্যাথলিক না হলে জর্ডনের জল অশুদ্ধ হয়ে যাবে। তখন বিদেশী ঠাকর ছেড়ে দেশের কুকুর। ওদের ভাষায় বলতে হলে মাই রিলিজিয়ন রাইট অর রঙ, মাই মাদার ড্রাঙ্ক অর সোবার।
হ্যাঁ, ড্রাঙ্ক অর সোবার কথাটা ওঠাতে ভালোই হ’ল। জয়সূর্য পৃথিবীর আর পাঁচ লক্ষ বাটলারের মত অধিকাংশ সময়ই থাকে ড্রাঙ্ক আর সোবারের মাঝখানে। আর মোকা পেলেই গুত্তা খেয়ে ড্রাঙ্কের দিকেই কাত। অবশ্য তাকে গডফাদার হতে হবে শুনে তমুহূর্তেই বেচারার নেশা কেটে গিয়েছিল। গবেটের মত বিড়বিড় করে কী একটা বলতে গিয়ে খেল ও-রেলির ধমক আর কড়া তম্বি,–অন্তত পরবের দিনটায় যেন সাদা চোখে গির্জায় যায়।
সে এক বিচিত্র বাপ্তিস্ম। মেবল্ দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতে অল্প অল্প কাঁপছে, ও-রেলি পাথরের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে, পাত্রী সায়েব নার্ভাস, আর জয়সূর্য তার বরাবরের গিঞ্জের পোশাক পরে বিহ্বলের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সবাই ভাবলে, ব্যাটা আজ টেনে এসেছে।
একমাত্র সোমই ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছুর তদারক করলে। পাদ্রী-টিলার মেয়েদের বেশীর ভাগই জয়সূর্য জাতের পরবের উৎকট দিকটা শুধু তাদেরই চোখে ধরা পড়ল না।
বাপ্তিস্মের পরই কিন্তু গির্জে থেকে বেরিয়ে জয়সূর্য না পাত্তা। সন্ধ্যের সময় সোম তাকে খুঁজে বের করল উজান গাঙের ঘাটে বাধা এক নৌকোর ভিতর। দু বোতল ধান্যেশ্বরী শেষ করে বুঁদ হয়ে বসে আছে।
সব খবরই আণ্ডা-ঘরে পৌঁছল।
বিষ্ণুছড়ার মেম বললেন, ডিসগ্রেসফুল।
মাদামপুর তার অন্তরঙ্গজনকে বললেন, থাক। এবার থেকে ওদের আর একদম ঘেঁটিও না। কাট দেম একদম ডেড। কী যে হল, কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনে।
দিশী কথায় বলে, ঐ বুঝলেই তো পাগল সারে।
.
০৯.
মুসলমান শাস্ত্রে বর্ণনা আছে, লাশ গোর দিয়ে লোকজন চলে আসার পর গোরের ভিতর কী কাণ্ড-কারখানা হয়।
কুরানে স্পষ্ট বলা আছে, ইয়োম-উল-কিয়ামত–অর্থাৎ প্রলয়ের দিন সবাইকে আল্লাতালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তিনি তখন সকলের বিচার করে ধার্মিককে পাঠাবেন স্বর্গে আর পাপীকে নরকে। এখন প্রশ্ন, কিয়ামত কবে হবে তার তো কোনো হদিস পাওয়া যায় না, এই মুহূর্তেই হতে পারে আবার এক কোটি বৎসর পরেও হতে পারে–ততদিন অবধি গোরের ভিতর মরাদের কী গতি হয়?
কুরান নয়–অন্য শাস্ত্রে বলে,–গোর দিয়ে আত্মীয়স্বজন চল্লিশ পা চলে আসার পর দুই ফিরিস্তা–দেবদূত–গোরের ভিতর ঢুকে তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার ইমান (ধর্মত) কী? সে যদি খাঁটি মুসলমান হয় তবে তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে, আল্লা এক, আর মুহম্মদ (দঃ) তাহার প্রেরিত পুরুষ। ফিরিস্তারা উত্তর শুনে খুশি হয়ে বলেন, তোমার ইমান ঠিক, কিন্তু এখনো তো কিয়ামতের কিছু দেরি আছে। ততক্ষণ অবধি এই নাও এক গাছা তসবী। আল্লার নাম স্মরণ করো। তারপর শাস্ত্র বলে, লোকটি খুশি হয়ে তব্বী হাতে নিতেই তার সুতোটি ছিঁড়ে গিয়ে তদ্বীর দানাগুলো কবরময় ছড়িয়ে পড়বে। সে তখন ব্যস্ত হয়ে দানাগুলো কুড়াতে না কুড়োতে দেখবে, কিয়ামতের শিঙে ফুকে উঠেছে–ছুটে গিয়ে আল্লার সামনে দাঁড়াবে আর সকলের সঙ্গে সারি বেঁধে।
আর যদি সে পাপাত্মা হয় তবে সে ইমান বলতে পারবে না। ফিরিস্ততারা তখন তাকে ধুনুরীরা যেমন তুলোর ভিতর যন্ত্র চালিয়ে দেয় ঠিক তেমনি তার সর্বসত্তা ছিন্নভিন্ন করে দেবেন–তুলোর মত সে বিশ্ব ব্রাহ্মাণ্ডময় ছড়িয়ে পড়বে। আবার সব কটা টুকরো জুড়ে দিয়ে ফিরিস্তারা আবার ঐ প্রক্রিয়া চালাবেন। পাপীর মনে হবে, এ যন্ত্রণা যেন যুগ যুগ ধরে চলছে।
অথচ পুণ্যাত্মারা হয়তো মরেছিল কিয়ামতের এক লক্ষ বৎসর পূর্বে; পাপাত্মা মরেছিল কিয়ামতের এক সেকেণ্ড আগে।
অর্থাৎ পুণ্যাত্মার বেলা আল্লা এক লক্ষ বৎসরকে তার চৈতন্যের ভিতর এক সেকেন্ডে পরিণত করে দেবেন, আর পাপাত্মার বেলা এক সেকেণ্ডকে লক্ষাধিক বৎসরে।
আজকের দিনের ভাষায় তুলনা দিতে বলা যেতে পারে পুণ্যাত্মার বেলা যেন তিন মিনিটের রেকর্ডের গতিবেগ বাড়িয়ে এক সেকেণ্ডে বাজিয়ে দেওয়া হ’ল, পাপাত্মার বেলায় সেই রেকর্ডই বাজানো হল এক ঘণ্টা ধরে।
তাই বোধ হয়, হিন্দু পুরাণেও আছে, নরের এক লক্ষ বৎসরে ব্রহ্মার এক মুহূর্ত।
কিন্তু এ কি শুধু মৃত্যুর পরই? জীবিত অবস্থায়ও তো ঐ-ই। মিলনের শত বৎসর মনে হয় এক মুহূর্ত, আর ক্ষণেক আড়ালে বারেক দাঁড়ালে মনে হয় লাখ লাখ যুগ ধরে সে যেন কোন সুদুরে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে।
মোতির মালা গল্পে তাই দীর্ঘ কুড়ি বৎসরের দুঃখ-দুর্দৈবের বর্ণনা মোপাসাঁ দিয়েছেন দশ ছত্রে আর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত খুনীর তিনদিন মেয়াদের বর্ণনা দিয়েছেন ঝুগো পুরো একখানা কেতাব লিখে।