মীরপুর ততক্ষণে আপন ভাবনায় ডুব দিয়েছেন। গুজোবটা তিনি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু এই যে বিষ্ণুপুরের বড় সায়েব জিনিসটাকে এত সীরিয়াসলি নিলে যে মেমকে পর্যন্ত ধমকে দিলে তবে কি?–কে জানে?
গুড নাইট।
গুড নাইট।
.
০৮.
আট বিষ্ণুছড়া আণ্ড-ঘরে গুজোবটার উপর যে বম-শেল ফাটিয়েছিলেন তার ধুয়ো কাটতে কাটতে কেটে গেল পুরো তিনটি মাস। তার সাহসকে পুরস্কার দেবার জন্যই বোধ করি গুজোবটাকে মৃতের প্রতি সম্মান দেখানো হ’ল সায়েবের উপর চটে গিয়ে বিষ্ণুছড়ার মেমও হপ্তা তিনেক ক্লাবে হাজিরা দেননি-ও নিয়ে বহুদিন ক্লাবে আর কোনো আলোচনা হল না। আর যত বড় রগরগে খবর কিংবা পরনিন্দা, পরচর্চাই হোক মানুষ এক জিনিস নিয়ে বেশীদিন লেগে থাকতে পারে না। পারলে কোনো ছেলেই পরীক্ষায় ফেল হত না, কোনো অবিষ্কারই অনাবিষ্কৃত হয়ে থাকত না। ইংরেজিতে এই মনোবৃত্তিরই নাম, গ্রাসহপার মাইও’, প্রতি মুহূর্তে হেথায় লম্ফ, হোথায় ঝম্ফ। ইতিমধ্যে আবার লাকাউড়া বাগিচায় একটা খুন হয়ে গেল। কলি-সদরের ডপকা বউ- মিস লাকাউড়া ডিস্পেনসারির কম্পাউণ্ডারের সঙ্গে ইয়ার্কি ফাজলামো করছিল বলে সে তার গলাটি কেটে গামছায় বেঁধে থানায় নিয়ে গিয়ে স্বহস্তে পেশ করেছে। পথে পড়ে চ্যাঙের খাল, তার সঁকোতে এক-এক পয়সা করে পোল ট্যাক্স দিতে হয়। সর্দারকে বাধা দিতে সে বললে, সরকারী কাজে থানায় যাচ্ছে, তার ট্যাক্সো লাগবে না।
কি সরকারী কাজ?
সর্দার গামছা খুলে মুণ্ডুটা দেখালে। সবাই নাকি দেখামাত্র পরিত্রাহি চিৎকার করে চুঙ্গীঘরের দরজায় হুড়কো মেরে জানলা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে, তুই শিগগির যা, তোর ট্যাক্সো লাগবে না, এ সত্যই বড্ড জরুরী সরকারী কাজ।
সর্দার নাকি এদের ভয় দেখে একটুখানি তাজ্জব বনে গিয়েছিল। ধীরে সুস্থে মুণ্ডুটা ফের গামছায় বেঁধে হেলে দুলে থানার দিকে রওয়ানা দিয়েছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট মরতুজা সাহেবের এজলাসে যখন সর্দার দাঁড়ালে তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই মেয়েটাকে খুন করতে গেলি কেন?
সর্দার বললে, করবা না? বেটি আমাকে বললে, দেখো সর্দার, আমার উপর তুই যদি চটে গিয়ে থাকিস তবে আর কোনো মেয়েছেলেকে নে না, এই দুনিয়াতে আমিই তো একহ-ই-ঠো লড়কী নই। আর তোকে যদি আমার ভালো না লাগে তবে তুইও তো একহ-ই-ঠো মর্দ নস; তুই বেছে নে তোর-টা, আমি বেছেনি হামার-ঠো। ঐসী বেতমীজ? হারামজাদী আমার মুখের উপর এইরকম বেশরম বাত বললে। তাকে খুন করে আমি সরকারী কাম করেছি, হুজুর। আমাকে এরা বেহ হাজতে পুরে রেখেছে, আপনিই বলুন হুজুর।
ম্যাজিস্ট্রেট সর্দারকে দায়রায় সোপর্দ করার সময় সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে ইংরিজিতে বললেন, দেয়ার ইজ এ লট অব টুথ ইন ওয়াট দি গার্ল সেড। ঐ খুঁটি কথাটি মেনে নিলে পৃথিবীতে খুনের সংখ্যা অনেক কমে যেত।
এই নিয়ে ক্লাব মেতে রইল খুনের খবর পৌঁছানোর থেকে সর্দারকে চোদ্দ বছর জেল পর্যন্ত। তারপর এই লাকাউড়া বাগিচার ছোট সায়েব করলে আত্মহত্যা। কেন করল তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউ বললে, দেশে যে মেম সায়েবের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি ছিল সে নাকি আর কোরো সঙ্গে ভিড়ে গিয়েছে, কেউ বলে, সায়েব যে এদিকে এক কুলি-রমণীর কৃষ্ণালিঙ্গনে চব্বিশ ঘন্টা চুর হয়ে থাকত সেই খবর শুনে সে রমণী অন্য পুরুষ খুঁজে নিয়েছে, কেউ বললে, তিনমাসব্যাপী ঝাড়া বাদলের ঠেলায় টিলার নির্জন বাসে খেপে গিয়ে মদ ধরে–তাও আবার কলীদের ধান্যেধরী–তারপর দিবা-রাত্তিরেও সে মদের নেশায় ছ-ঠ্যাঙওলা বাঘের দিকে সে অনবরত গুলী ছুঁড়তে থাকে, শেষটায় বাঘ নাকি তার মাথার ভিতর ঢুকে যায়, চিৎকার করে সেই ফরিয়াদ জানাতে জানাতে একদিন সেই বাঘকে আপন কানের ভিতর দিয়ে পিস্তলের গুলী চালিয়ে খুন করে।
ততদিন ও-রেলিদের কথা প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে। ক্লাব যখন গুলজাবের তাড়িতে মত্ত তখন ও-রেলির বংশধর জন্মের খবর পৌঁছল পানসে শরবতের মতো। কেউ সামান্য চাখলে,অর্থাৎ জিঞ্জেস করলে, তাই নাকি, কবে হ’ল? কেউ সামান্য ভুরু কোঁচকালে। মুরুব্বিরা বললেন, ভালোই হয়েছে, বাচ্চাই অনেক সময় বাপ মায়ের মাঝে সেতু হয়ে দুজনাকে এক করে দেয়।
শুধু বিষ্ণুছড়ার মেম বাঁকা হাসি হেসেছিলেন।
সে হাসির অর্থ, বলা কিছু শক্ত, কারণ এটা ব্যক্ত–দু জাহজের মাঝখানে তা পেতে যেমন এ-জাহাজে ও জাহাজে জোড়া লাগানো যায় টিক তেমনি ঐ তক্তা তুলে ধাক্কা মেরে দু নৌকার মাঝখানের দূরত্ব বাড়িয়েও দেওয়া যায়।
পয়লা বাচ্চার ব্যপ্তিস্ম করার সময় ক্যাথলিকরা ধূমধড়াক্কা করে বাঙালী ঠাকুরদার পয়লা নাতির অন্নপ্রাশনের চেয়েও বেশী। মেবল্ কিন্তু সবকিছু সারাতে চেয়েছিল সাদামাটাভাবে। ও-রেলি দেখা গেল ঠাকুরদা গোত্রের। সে চায় পালা পর করতে। ওদিকে পাদ্রী জোনস সাহ্বে প্রটেস্টানট তিনি ক্যাথলিকের বাচ্চাকে বাপ্তিস্ম করবেন কী করে? এ যেন পাড় বোষ্টমের ছেলেকে শাক্ত দিচ্ছে মদীক্ষাশানে মড়ার উপর মুখোমুখি বসে মড়ার খুলিতে কারণ-ভর্তি-হাতে! ও-রেলি কিন্তু জোনসকেই অনুরোধ করলে বাপ্রিশ্মের তাবৎ ব্যবস্থা করতে।
গড ফাদার অর্থাৎ ধর্মপিতার অভাব মধুগঞ্জে হত না। মাদামপুরের বড় সায়েব, ডি, এম, যে-কেউ আনন্দের সঙ্গে রাজী হতেন, পুয়োর ডেভিল-বেচারা–একলা একলি মনমরা হয়ে থাকে, ঔটুকুতে যদি সে খুশি হয় তবে হোয়াই নট-নিশ্চয়ই অফ কোর্স অবশ্যি, অতি অবশ্যি। কিন্তু ওদিকে দেখা গেল, ওবেলি পাড় ক্যাথলিক ক্যাথলিক বাচ্চার গডফাদার হবে প্রটেস্টানট। মন্ত্র যে খুশি পড়াক, বাপ্তিস্ম যে খুশি করুক, সে তো পাঁচ মিনিটের ব্যাপার; কিন্তু ধর্মকাপ তামাম জীবনের। সেখানে প্রটেস্টানট হলে চলবে কেন? কলমা যে খুশি পড়াক কিন্তু মুরশীদ ধরার সময় দেখে বেছে নিতে হয়।