আংটি একটা। অপরাধীর হাসি হেসে বলেছিল, জন্মদিনে নন্দিনকে দিও।
প্যাসেঞ্জার্স অফ ফ্লাইট নাম্বার থ্রি-ও-থ্রি আর বিয়িং রিকোয়েস্টেড টু রিপোর্ট ফর চেকিং ইমিডিয়েটলি এই মাইক্রোফোন-ঘোষণার নিচে আন্ডারলাইন টানার মতো ঘোষণাটির সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে সুমিতা বলে যায়, “বাবা, আর কত কী দেবেন মেয়েকে। বিয়ের তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন যে… বলে সেট্রলির ওপর ঢাউস স্কাইব্যাগ দুটির দিকে সহাস্য ইঙ্গিত করে, যার মধ্যে সত্যিই প্রায় সবই নন্দিনের জিনিস। জামাকাপড়ের কথা বাদ দিলেও, আমসত্ত্ব থেকে সন্দেশ, মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে ভাজামৌরি থেকে বই-রেকর্ড-ক্যাসেট—কী যে নেই ওতে। শুধু একটা ক্যাসেটের কথাই ধরা যাক। সুচিত্রা মিত্রের বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। সে আর নন্দিন দুজনে গত বইমেলায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে গানটি শুনেছিল। না ক্যাসেট, না রেকর্ড—কোথাও গানটি পাওয়া গেল না। অথচ, শুনেছে। বইমেলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে গানটি আগাগোড়া শুনেছিল নন্দিন। দাঁড় করিয়ে রেখেছিল হিরণকেও। গান শেষ হলে একটি কথা না বলে, কী অপূর্ব, না বাবা?— চোখে তাকিয়ে ছিল হিরণের দিকে। তাই, খোঁজ, খোঁজ। নন্দিনের জন্য সুমিতার হাতে পাঠাতে হবে ক্যাসেটটা। একটা পুরো দিন লেগেছিল একলা চল রে নামে আসোর্টেড ক্যাসেটে গানটি আছে এই তথ্য সংগ্রহ করতে ও ক্যাসেটটি কিনতে। খুব ছোটবেলায়, বছর-দেড়েকের তখন নন্দিন। নন্দিন তো নয়, তখন শুধু নিনি। তখনও নামকরণ হয়নি। বেবি ফুডের খুব ক্রাইসিস চলছে, অথচ বাড়িতে আছে আর কচামচ– আজকের দিনটা কোনওমতে চলবে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে, আর যার হাতেই দেখেছে ফুডের টিন— দাদা, কোথায় পেলেন?জানতে চেয়ে দোকানের নাম শুনেই সেখানে ছুটে গেছে তা সে বাগরি হোক, রাধাবাজার হোক, বড়বাজার হোক— লিটারালি ছুটতে ছুটতেই গেছে, এবং কোথাও পায়নি। শেষ সংবাদসূত্র ধরে মনোহর কাটরার পানবাজার বলে একটি বাড়ির বিশাল ছাদে সিঁড়ি-উপসিঁড়ি ধরে শেষ পর্যন্ত অকুস্থলে পৌঁছে তা বেশ কয়েকশো পানের ঝুড়ির একপ্রান্তে একটি টেবিল-চেয়ার ও পাশে গুনে দেখে ঠিক পঞ্চাশটা ল্যাকটোজেন–কৌটো (তখনও বিল কাটা শুরু হয়নি), সে শেষ থেকে লাইনের লোকগণনা শুরু করে ও সাতচল্লিশ পেয়েই দৌড়ে লাইন দিতে যেতে-যেতেই আরও তিনজন দাঁড়িয়ে যায়। ওঃ, ক্যাসেট-জোগাড়ের মতো সে এমনি আর একটা সারাদিন নন্দিনের, না-না, নিনির জন্যে কেটেছিল বটে।
সেদিন বেহালায় গিয়ে বন্ধু সত্যেনের বৌ-এর কাছ থেকে একদিনের মতো ফুড ধার করে বহুরাত্রে বাড়ি ফিরেছিল। এবার তো তবু দিনের শেষে পেয়ে গিয়েছিল ক্যাসেটটা।
শ্যালক কল্যাণের বাড়িতে, নন্দিনের প্রথম বিদেশি জন্মদিনে রাত সাড়ে নটায় কানেকশন পাওয়া গেল। হ্যালো, টোকেন এস-এক্স টেন, উই আর ট্রায়িং দ্য ইউ, এস. এ. লাইন, প্লিজ, হোল্ড অন… পিপ-পিপ-পিপ-পিপ… হ্যালো নদা… পিপ-পিপ-পিপ-পিপ তারপর বোধহয় তো অ্যাটল্যান্টিকেরই হাওয়া ঢুকে পড়ল লাইনে। শুধু সাঁই সাঁই শব্দ।
হ্যালো, নদা, হ্যাঁ, এখন এখানে সকাল ৯টা নন্দিন একটু আগে উঠেছে। চা করছে। হ্যাপি বার্থ ডে ফ্রম ড্যাড বলে প্রথমেই আপনার আংটিটা দিয়েছি। হ্যাল্লো…হা শুনতে পাচ্ছেন… খুব পছন্দ! তবে রিং ফিঙ্গারে হয়নি। একটু ছোট হয়েছে। মোটা হয়ে গেছে তো বেশ। আচ্ছা, পাথরটা কি চুনী? কৌটোর ডালা খুলে একদম কেঁদেই দিল। কিছু শুনতে পাচ্ছেন?
না, কী শুনব?
এটা একটা কার্ড। মাউথ-পিসের কাছে ধরে আছি। খুললেই হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ-এর সুর বাজে। শুনতে পাচ্ছেন না? ওর এক কালো বন্ধু, নাম ক্লারা, দিয়েছে। ষোলটা কার্ড পেয়েছে। ওর কলেজের বন্ধুরা এখুনি এসে পড়বে। সারাদিনের জন্যে নিয়ে যাবে। মারিপোজে বলে একটা সুন্দর শহরে ওরা যাবে। লাঞ্চ করবে। আমরা সন্ধেবেলা ওকে নিয়ে বেরোব। নিন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন…
নন্দিন ডালা খুলে কেন কেঁদে ফেলেছিল তা শুধহিরণেরই জানারকথা। ডালার লাল ভেলভেটের ওপর একটা ছোট সাদা কাগজ পিন দিয়ে আটকে দিয়েছিল সে, যাতে মেয়ের নাম নেই, শুধু লেখা: সোনার চেয়ে দামিকে। অন্য ডালায় আংটির সোনা! পড়েই ও কেঁদেছে নিশ্চয়। ভাষা কাঁদিয়েছে। কেঁদেছে, কাঁদুক। কাঁদাবার জন্যই তো লেখা। কাঁদা ভাল রে নন্দিন। অস্তিত্বের স্নান হয়।
মিনিটে ৩০ টাকা। শ্যালক কল্যাণ তিন আঙুল দেখিয়েছে। মানে তিন মিনিট হয়ে গেল। সবাই কথা বলবে।
হিরণ, কীরে কেমন আছিস? জানতে চাওয়া মাত্র অতলান্তিকের ওপার থেকে অস্তিত্বের স্নানশব্দ! সে নে মায়ের সঙ্গে কথা বল বলে তাড়াতাড়ি রিসিভারটা চিনুর হাতে তুলে দেয়। চিন হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফোনের ওপর। কীরে নন্দিন, কেমন আছিস, নন্দিন…নন্দিন…কীরে কাঁদছিস কেন এ ছাড়া সে কিছু বলতেই পারছেনা দেখে, একরকম কেড়ে নিয়েই সে রিসিভারটা শ্যালকের হাতে তুলে দেয়।
বেকার রোড দিয়ে তোড় বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সি চলেছে পা টিপে। ওয়াইপার কাজ করছে না। কোমরের গামছা খুলে ফেলে লেদু মাঝে মাঝে কাচ মুছে দিচ্ছে।
তাহলে লেদু, এত বলে ভবানীভবন থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি পর্যন্ত আর কিছু না বলে, তারপর হিরণ জানতে চাইল, তাহলে লেদু তুই আমাকে যা বলেছিস সেটাই কী সব?