এমার্জেন্সিতে ডিউটি ছিল টেকো তপনের। সে বছরেই তপন আর রঞ্জন বেলুড় বিদ্যামন্দির থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে মেডিকেলে ঢুকেছে। মেডিকেল কলেজের গেটে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, তপনই তাকে প্রথম জানায়, হিরুদা, শুনেছ, বাদলদা কাল ওয়েস্ট জার্মানি চলে গেছে?
ডানা-মেলার, না তো, পালতোলার সেই শুরু।
কিন্তু, বাদল! ওয়েস্ট জার্মানি! শুনে কী ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে।
বলতে বলতেই তপনের বাস এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি ২নম্বর দোতলারফুটবোর্ডে লাফিয়ে উঠে, চলন্ত বাস থেকে হাত নেড়ে তপন চেঁচিয়ে বলেছিল, “রঞ্জনের কাছে সব শুনে নিও।
ওয়েলিংটনের দিকে শীত-কুয়াশার জন্য বেশিক্ষণ বাসটা দেখা যায়নি। যতক্ষণ যায়, তারপরেও বহু সময় সেদিকে তাকিয়ে ছিল হিরণ।
ছিপছিপে, মিষ্টি ও মাকুন্দ, মেয়েদের চেয়েও সুন্দর, গোটা স্কুলজীবন জুড়ে, আহা, কী অকথিত প্রেমেই যে সে পড়েছিল বাদলের। উত্তরা সিনেমায়, ক্লাস টেনে পড়তে, টেস্ট পরীক্ষা ও ম্যাট্রিকুলেশনের মাঝখানের সময়টা সিনেমার নেশায় পেয়ে বসে হিরণকে। সঙ্গে থাকত, সব সময়, ক্লাস নাইনের ছোটভাই রঞ্জন। বাদল বসত মাঝখানটিতে। কত ছবিই না তারা দেখেছে একসঙ্গে। মনে পড়ে ঝামাপুকুরের কীর্তি সিনেমায় (এখন জহর) প্রথম দেখা বাজি। সরমায়ে কাহে, ঘাবড়ায়ে কাহে, বা, সি. আই. ডি-র যাত্তা কাঁহা হ্যায় দিওয়ানে, কাকুর লিপে গীতা দত্তর কিন্নরীকণ্ঠ, ও. পি. নাইয়ারের সুর— যার মধ্যে ছিল, তেরা দিলমে ফিফটি, মেরা দিলমে ফিফটি-জমানা হত্যায় পুরা…ইত্যাদি। একটা গান খুব গাইত বাদল। হো, যারা ধোঁকে হ্যায়, ধোঁকে হ্যায় পিছলে জমিন/বাবুজি ধীরে চলনা/পেয়ারমে জারা সামহালনা.. এটা কোন ছবির কিছুতেই মনে পড়ে না আজ। মনে পড়ে গীতা দত্ত অনুকরণে কী অবিকল লচক-সহযোগেই না সে যাতা-কে যাত্তা আর সামালনা-কে সামহালনা করতে পারত।
স্কুলে পড়তে শ্রীতে কবি দেখতে দেখতে, বসন যখন ঢলে পড়ল মৃত্যুতে, তার মাথার কাছে প্রদীপটা শেষবার কেঁপে উঠে দপ্ করে নিভে গেল, তখন সেই বিপুল ট্র্যাজেডিতে কী উন্মথিত না হয়েছিল তারা তিনজনে একসঙ্গে, সে, বাদল আর রঞ্জন। বাদল তার ঘাড়ে মাথা রেখে বলেছিল, কীরে, কিছু বলবি? মানে, ইজন্ট ইট সুপার্ব?
মায়, একসঙ্গে ঘাটশিলা গিয়েছিল। তারা তিনমূর্তি।
সেই বাদল এই মুহূর্তে জার্মানিতে। সত্যি, এর চেয়ে রহস্যময় বুঝি আর কিছু হয় না। অন্তর্ধান ছাড়া একে আর কী বলা যায়, নেতাজির পরে। এ অপার রহস্যের বিস্তৃত বিবরণ সে আর রঞ্জনের কাছে বাড়ি ফিরে কী শুনবে।
পরে বুঝেছে, লাইনে থাকলে, সেও তখন চলে যেতে পারত। তার হাতের আজন্ম-অটুট বিদেশ-রেখাটি তখনই মাহাত্ম্য পেতে পারত এবং অনেক সহজেই। যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপে তখন নারী-শিশু আর বালক-বালিকার ভিড়-পৃথিবীর সর্বত্র থেকে পশ্চিম জার্মানিতে ইমপোর্ট হচ্ছে সক্ষম ও সাবালক যুবকের পাল, বিশেষ করে ওয়েস্ট জার্মানিতে যেতে ভিসাটিসার বালাই তখন একদমই ছিল না। পরে জেনেছিল, বাদল আসলে ওখানে একটি পাঊরুটির কারখানায় ময়দার বস্তা তোলার কাজ পেয়েছে।
তুলুক বস্তা। তবু তো বিদেশ! স্টুটগার্ড। জার্মানি। ওক, বিচ, এলম, বার্চ। ব্ল্যাক ফরেস্ট। নদীর নাম রাইন। চারিদিকে ফুটফুটে সাদা দেবদেবী। ঝকঝকে রাস্তা। ঝকঝকে বাড়ি। বাড়ির চারচালায়, ফুটপাথের ধারে ধারে, গাছের পাতায় কোথায় নয়—নীল বরফ।
মেম। মেম মানেও সেই বরফ-ব্লু দিয়ে মাজা সাদা-সাদা পা, ঊরু পর্যন্ত উন্মুক্ত। সে সময় কলকাতায় ৬০ ভাগ লোক ধুতি পরত। তাই শুনে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল, বাদল এখন সেই দেশে যে-দেশে পুরুষরা পা ঢেকে রাখে এবং মেয়েরা তা খুলে দেখায়।
সেই শুরু। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়-পর্বে ঢোকার আগে, পরে আশপাশ থেকে আরও অন্তর্ধান শুরু হল। ততদিন অবশ্য যাওয়া বেশ টাফ হয়েছে, ভিসা তো লাগেই, লাগেজব-ভাউচার… তবুযাওয়ার যেন বিরাম নেই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কেউ গেল কানাডায়, কেউ আমেরিকায়। অধিকাংশ ব্রিটেনে।
তা বলে, এম. বি. বি. এসের রেজাল্ট বেরনোমাত্র রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে, রঞ্জন তাকে এসে বলবে, নদা, আমি বিলেত যাব, তুই কিছু টাকা স্ট্যান্ড করতে পারবি?–এ জন্যে হিরণ মোটই প্রস্তুত ছিল না।
০৩. হ্যাঁ, আমি নন্দিন
লেদু একটা ট্যাক্সি এনেছিল। এক বস্ত্রে চিন্ময়ী আর হিরণ বেরিয়ে পড়ল। যে গামছাটা দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিচ্ছিল চিনু, সেটা সেই থেকে ওর কাঁধেই থেকে গেছে। কী না ভেবে যে লেদু সেটা শক্ত করে কোমরে বেঁধে নেয়!
২৭ এপ্রিল। রাত এখন ১টা হবে। তার মানে মার্সেদে এখন, আজই, বেলা ১টা কি দেড়টা। ওরা কমবেশি ১২ ঘণ্টা পিছিয়ে। উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নের জন্যে আধঘণ্টা এদিক-ওদিক হয়। মার্সেদের সময়ের হাড়হদ্দ হিরণের জানা। নন্দিনকে শেষ ফোন করল এই তো সেদিন, ১২ এপ্রিল। ভবানীপুরে চিনুর দাদার বাড়িতে গিয়ে সন্ধেবেলা কল বুক করে টোকেন নম্বর হাতে বসে থাকা। সময় দেওয়া হয়েছিল এখানকার রাত ৯টা। উপলব্ধিতে পাওয়া মুশকিল, তবু ওখানে তখন, সেদিনই কমবেশি সকাল ৯টা হতে বাধ্য।
এ-বছর ফেব্রুয়ারির গোড়ায়, সুমিতা ফিরে গেল। এয়ারপোর্টের মাইক্রোফোন-সিস্টেমে ফ্লাইট নং থ্রি-ও-থ্রির প্যাসেঞ্জারদের ডাকছে এমন সময় ভ্রাতবধর হ্যান্ডব্যাগে, আর সবাইকেলকিয়ে, টুক করে একটা ছোট্ট বাক্স ফেলে দিয়েছিল হিরণ।