জেফ দাঁড়িয়েছিল পাশেই। সে হাসতে হাসতে তখুনি তাকে একটা চেক লিখে দেয়।
লাঞ্চের প্লেট হাতে জেফ আমাকে একান্তে ডেকে বলল, আজ রাতে মার্সেদের বাড়িতে মিটিং। আমার লিস্ট অনুযায়ী সে রঞ্জনের বন্ধদের আজকের মিটিংয়ে আসতে বলেছে। আজ রাতটা হোটেলে কাটিয়ে ওরা সকালে যে যার জায়গায় ফিরে যাবে। আজ রাতেই ওর গার্জেন এবং সম্পত্তির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ঠিক করতে হবে। এই বিশাল সম্পত্তি, আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডেও যাবিশাল, এভাবে বেওয়ারিশ পড়ে থাকতে দেওয়া আর উচিত হবেনা। সোমবার কোর্ট খুললেই পিটিশন করতে হবে।
নট দ্যাট, আই অ্যাম পুশিং। জেফ বলল, তুমি আমাকে গার্জেন করতে পার। ডাঃ চ্যাটার্জি কনসিডার্ড মি ট্রাস্ট-ওয়ার্দি ফর দা লাস্ট টেন ইয়ার্স।
আমি বললাম, ধন্যবাদ জেফ। তুমি অনেক করেছ। আমাদের চ্যাটার্জি-পরিবারকৃতজ্ঞ তোমার কাছে। কিন্তু গার্জেন আমি ঠিক করে রেখেছি।
শুধু জেফ কেন, অনেকেই আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে একই কথা বলল। সবাই জেনে গেছে যে, আমি ফিরে যাচ্ছি। বেশ কয়েকজন রেকমেন্ড করল ধূর্জটি পালিতকে। ধূর্জটি মিটিং-এ আসছে রীতিমতো একটি লবি নিয়ে। প্রায় সকলেই এই পিতৃমাতৃহারা অনাথের দ্বিতীয় পিতামাতা হতে আগ্রহী। শুধু ছন্দা আর অমিয় কিছু বলল না।
ফেরার পথে জেফ-এর গাড়িতে আমি আর অঞ্জন। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে বলে আর কারুকে গাড়িতে উঠতে দিইনি।
অঞ্জন বাংলায় বলল, বলো।
আজ তোমার গার্জেন ঠিক হবে।
আমি জানি।
তোমার কাকে পছন্দ।
আই লাইক হ্যারি কেলার।
ন্যান্সির বাবা?
হ্যাঁ মাইল পাঁচেক চুপ করে থেকে আমি বললাম, বাট আই ডু নট লাইক হিম।
হু আর ইউ?
ইন দ্যাট কেস, আমি অ্যাম নট লিভিং ইউ. এস. এ। আমি তোমার গার্জেন হয়ে থাকব।
তুমি তোমার মেয়ের জন্যে এসেছ। মেয়েকে নিয়ে যাও। আমি যদি একা থাকতাম, তুমি কি আসতে?
আমি আমার ভাই-এর, ভ্রাতৃবধূর এবং ভাইপোর ফিউনারালে এসেছি।
আমি ইন্ডিয়ান গার্জেন বালোবাসি না। ও আবার বাংলায় বলল। তারপর বলল, আই হেট ইন্ডিয়ান বেগার্স।
একটা চড় মারার জন্যে আমার হাত উঠে গিয়েছিল। তখন যে মারিনি এটা ওর বরাত।
রাতের মিটিং-এ আমি রঞ্জনের বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের বন্ধু চুনীলাল রায়ের নাম প্রস্তাব করলাম। হ্যারিকেমিটিং-এ ডাকিইনি। চুনী বৌ সুজিকে ফোন করে তার অনুমতি নিল। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বলল, দাদা, এত বড় গুরুভার…
তুমি ছাড়া আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, রুনুর ছেলেকে আর কার হাতে তুলে দিয়ে যাব চুনী? তুমিই বলো, কাকে।
মিটিং-এর পর রঞ্জনের সেলার খোলা হল। নিজে মদ খেত না। কিন্তু পৃথিবীর সেরা পানীয় ওখানে থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে। চুনী ওখান থেকে গ্লেন ফিডডিশের একটা বড় বোতল নামাল।
অনেক রাত অবধি রঞ্জন-সুমিতাকে নিয়ে মজার মজার গল্প হল। সবাই কিছু না কিছু বলল। চুনী বলল, লন্ডনে থাকতে, বুঝলেন দাদা,সুজিকে ভালবাসতাম আমরা দুজনেই। সুজি অনেকদিন মন ঠিক করতে পারেনি। দুজনের সঙ্গেই ডেট করত। তারপর একদিন বিকেল বেলা, সাইকেল নিয়ে আমরা তিনজনে একটা নদীর ধারে বেড়াতে গেছি। ফাগুন মাস। বুঝলেন দাদা। যতদূর দুচোখ যায় শুধু চেরি, চেরি, চেরি… শুধু চেরির ক্ষেত। বুঝলেন দাদা। কেউ কোত্থাও নেই। আমি আর সুজি একটা উত্নাই বেয়ে তরতরিয়ে অনেকটা নেমে গেছি, এমন সময় সেই ফাঁকা মাঠে, সেই বিশাল চেরি-ক্ষেতের মাঝখানে, বেশ চেঁচিয়ে, বুঝলেন দাদা, সুজি আমাকে প্রপোজ করল। ব্যস, আর কথা নেই। সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে চড়াই ভেঙে উঠে এসে আমি রঞ্জনকে বললাম, তখন দারুণ হাঁফাচ্ছি, সুজিঃ, সুজিঃ, সুজিঃ, আমাকে প্রপোহোজ করেছে। কীঃ বহলব, তুই বহল। একটু জেলাস হয়নি। বুঝলেন দাদা। হি হ্যাড আ লার্জ হার্ট–মাচ মাচ লার্জার দ্যান মাইন…
চুনী খুব তাড়াতাড়ি ড্রাঙ্ক হয়ে পড়ল।
বাড়ির পিছনের মাঠে যাওয়ার দরজা দিয়ে বেরিয়ে সবাই যখন একে একে গাড়িতে উঠল, তখন রাত কত তা জানি না। এখানে এসে এই প্রথম আমি মদ খেয়েছি। বেশ নেশা হয়েছে আমার। আমি মাঠের শেষে সাদা কাঠের বেড়া পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। আজ বেশ শীত। হিম পড়ছে। আল কাপিতানের পিছনে আজ পূর্ণিমার চাঁদ। গোটা সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা ঝকঝক করছে।
তারপর একখণ্ড ঘন কালো মেঘ এসে চাঁদের প্রায় সবটা ঢেকে দিল। সরে যেতে সময় নিল অনেকক্ষণ।
শোওয়ার আগে নন্দিন আমাকে বলল, এক হাজার ডলার নিয়ে অঞ্জন রিনো নেভাদায় গেছে। এখনও ফেরেনি।
সেখানে কী হয়?
সে একটা ছোটখাটো লাস ভেগাসের মতো। সমুদ্রের ধারে। সেখানে সারারাত জুয়ো খেলা হয়।
কত দূর এখান থেকে?
তা একশো মাইল তো হবেই।
ফিরবে কী করে?
বন্ধুদের সঙ্গে পোর্সাটা নিয়ে গেছে। পোর্সাতে এক ঘণ্টার ড্রাইভ। বন্ধুদের সঙ্গে ফিরবে। যেন এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু হয় না। এমনভাবে নন্দিন বলল, ন্যান্সি ভাল ড্রাইভ করে।
১৬ মে।
ভোর রাতে রাস্তার দিকের গ্লাস প্যানেলে টোকা।
নন্দিন, ওপেন দা গ্যারাজ।
ওই, অঞ্জন এসেছে। নন্দিন ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, আজকাল এইরকম রাত করে বাড়ি ফিরত। আমি গ্যারাজ খুলে দিতাম। কাকিমা সব জানত। ছোটকাকাকে বলতে বারণ করেছিল। বলতে বলতে সে সুইচ বোর্ডের একটা বোতাম টেপে। ঘড়ঘড় করে বাইরে গ্যারাজের শাটার ওঠার শব্দ।
দরজা খুলে আমি করিডোরের মুখে গিয়ে দাঁড়াই।