এত আগ্রহ! এ কি নয় নিদ্রাতুরার যাই বলে নিশিডাকে সাড়া দিয়ে ওঠা। আমার তখনই ভীষণ অমঙ্গলময় মনে হয়েছিল।
ফিরে যাওয়ার সময় সব গেল। শুধু হারমোনিয়ামটি গেল না। ওজনে শুধু ওটাই বেশি হয়ে গেল?বিশাল স্কাইব্যাগ ফেলে যাবে, তবু হারমোনিয়ামটি সে ছেড়ে যাবে না কিছুতে। আমি কথা দিলাম, যত তাড়াতাড়ি পারি পাঠিয়ে দেব।
সব গেল। আনক্যারেড লাগেজ হিসেবে গেল না শুধু হারমোনিয়ামটি। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল কেন। স্কাইব্যাগ রেখে, হারমোনিয়ামটা ওকে কেন যে তখনই নিয়ে যেতে দিইনি। তাহলে তো, ২৫ এপ্রিলের ভোররাতে, ৯১ নং ফ্রি-ওয়ে ছেড়ে ১১৩ নং ধরে ওভাবে
সহসা বেঁকে সানফ্রান্সিসকোর দিকে সে স্বামীপুত্রকে টেনে নিয়ে যেত না।
কেন না, এ শুধু গোলাপ জানে, আর বকুল জানে, আমি জানি আর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স জানে যে, সেই আনক্যারেড হতমানিনী হারমোনিয়ামটি সানফ্রান্সিসকো বিমানবন্দরের এয়ারকার্গোর অন্ধকার গুমঘর থেকে প্রেতিনীর হাতছানি দিয়ে তখন ওকে ডাকছিল।
১০ মে।
কাল লিভারমোরে শ্রাদ্ধ। লেদু ফিরে এসেছে।
কত খড়কুটোই যে এই অটুট ধ্বংসস্তুপ থেকে তুলে এনে সে আমাকে মাঝে মাঝে দেখায়। কাল কোথা থেকে পেয়ে একটা ছোট্ট, খুব গরিব কার্ড এনে দেখাল। তাতে লেখা: ডাঃ রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, সুচরিতে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। গ্রহণ করুন। চিন্ময়ী রায়চৌধুরি। ৭ আগস্ট। ১৯৬৭
তখনও বিয়ে হয়নি আমাদের। কার্ড হাতে পেয়ে বুঝলাম, এটা আসলে ছিল রঞ্জনের কাছে চিনুর একটা নোটিস। যে, আমি আছি। আমি আসছি।
কার্ডটা উল্টে দেখি, পিছনে রঞ্জনের হাতে লেখা: ভাই নদা, আমার…
ব্যস এইটুকু। আর কিছু লেখেনি। ২০ বছর পরে মার্সেদে ওদের বাড়িতে বসে আমি, ভাই নদা আমার উচ্চশিক্ষার্থে এ মহাশ্মশান যাত্রার শেষ কোথায় এভাবে বাক্যটি সম্পূর্ণ করছি দেখি।
১০ মে।
হাইওয়ে ট্রাফিক ট্রেলের ডিউটি অফিসার সার্জেন্ট ববি স্টিলম্যান এসেছিল কালো পোশাকে শোকপ্রকাশ করতে। বয়স হবে ২৪/২৫, দেখতে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতো। মাথায় বালি রঙের পাতলা চুল যা কপালের দুপাশ থেকে ধনুকাকারে বেঁকে এই বয়সেই পিছন পর্যন্ত ঝরে গেছে। দেখে মনে হয়, শিগ্গিরই সবটায় টাক পড়ে যাবে। বৌ বলে যার পরিচয় দিল সেও রীতিমতো ঢ্যাঙা, শরীরে-স্বাস্থ্যে তাকে একটি মেয়ে-রোবো বললেই হয়।
ববি বলল, অ্যাক্সিডেন্ট রিপোর্ট পাওয়া গেছে। গাড়ি চালাচ্ছিল সুমিতা। গোলাকার লাল মাথাভর্তি কালো কালো তিল চুলকে সে আমাকে নানাদিক থেকে সান্ত্বনা দেয়। যেমন, যাক, ছেলেটা তো বেঁচে গেছে। তোমার মেয়ের তো যাওয়ার কথা ছিল ওদের সঙ্গে, তাইনা? ইত্যাদি। কুকুতে নীল চোখ থেকে স্টিল ফ্রেমের শৌখিন প্যাশনে খুলে এই ববিই আমাকে শেষ পর্যন্ত ভৌত-বিজ্ঞানের এক পরমাশ্চর্য খবর জানাল। যেভাবে মুহূর্তে দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল, সে বলল, তাতে গাড়ির ভেতরে অক্সিজেন ২ থেকে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার কথা। এদিক থেকে মৃতরা দগ্ধযন্ত্রণা ভোগ করেনি বললেই হয়। তার আগেই অক্সিজেনের অভাবে তারা মরে গেছে।
ইট ওয়জ মিয়ারলি দ্য কর্পসসেস দ্যাট দা ফায়ার কুড বার্ন– সে এভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে।
বিদায় দিতে গিয়ে দরজা বন্ধ না করে আমি অপসৃয়মাণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওরা এসেছিল একটা লম্বাটে কালো পুরনো মডেল ভ্যান গাড়িতে চেপে। অবিকল হিন্দুসকার সমিতির গাড়ি।
১০ মে।
২৮৫৬ হোয়াইট গেট ড্রাইভে যখন ঢুকি, মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বাড়ির প্রবেশদ্বারে উৎকীর্ণ রয়েছে ৩৫ শতাব্দী আগেকার সেই ফলক, যাতে লেখা:
মৃত্যুর ডানা তাকেই স্পর্শ করুক
যে নিদ্রাভঙ্গ করবে এই প্রবলপ্রতাপ ফারাও-এর
যিনি এখানে শুয়ে আছেন
অনন্তকালের জন্য…
যা লেখা ছিল টুটানখামেনের সমাধিমন্দিরের প্রধান ফটকের ওপর। ভয় হয়, শৃগাল-দেবতা আনুবিস এ-বাড়ির মধ্যে কোথাও হাঁটু পেতে বসে আছেন।
১৬. নিরস্ত্রের যুদ্ধে যাই, শস্ত্র হয় মন
১৬ মে।
আমাদের তিনজনের ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কনফার্মেশন হলে কাল ১৭ মে আমি আর নন্দিন দেশে ফিরে যাচ্ছি। আজ বিকেলের বাসে আমরা সানফ্রান্সিসকো যাব। লেদু কদিন থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সে ডিজনিল্যান্ড, হলিউড, লাস ভেগাস এ–সব দেখে-টেখে যাবে। লস এঞ্জেলেসে সে থাকবে বেভার্লি হিলস্-এ। পৃথিবীর সবচেয়ে পন্ জায়গা। এক স্কোয়্যার ইঞ্চি জমির দাম কত জানো? প্রশ্নোত্তরে সে জানায়, ২০০০ ডলার!
১১ মে, শনিবার সকালে লিভারমোর মন্দিরে রঞ্জন, সুমিতা আর জীয়নের শ্রাদ্ধ হল। শ্রাদ্ধ করালেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রবিচন্দ্রন আয়ার। ওদের তিনজনের ছবির সামনে তামার পাত্রে অ্যাসেস, কুশাসন, কুশের আংটি থেকে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। ছন্দা, এমনকি, প্লাস্টিকের আম্রপল্লবও টাঙিয়ে দিয়েছিল।
১০০০ ডলার তাকে দিতে হবে এই শর্তে অঞ্জন ন্যাড়া হয়েছে। শ্রাদ্ধের সময় চোদ্দ না হলেও, নবদ্বীপের টিকিধারী বোষ্টম ঈশ্বর ভোলানাথ দেবশর্মন থেকে সাত পুরুষের নাম সে বলল। শ্রাদ্ধে রঞ্জনের ধুতি-পাঞ্জাবি আর চটি পরে আমাকে যেতে হয়। ছন্দার নির্দেশমতো শ্ৰাদ্ধান্তে চটি থেকে পা খুলে আমি অঞ্জনের সামনে দাঁড়াই। সে পায়ে হাত দিয়ে আমাকে নমস্কার করল না। উল্টে হোমের ধোঁয়ায় রক্তাভ চোখ তুলে বলল, আস্ক জেফ কোনিগ টু পে মি ওয়ন থাউজান্ড ডলার্স টো-মোরো।