গ্রিক নাট্যকার এসকাইলাস জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন। তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখের মধ্যে মাথায় আঘাত লেগে তাঁর মৃত্যু হবে। এসকাইলাস দিকচিহ্নহীন প্রান্তরে গিয়ে বসে রইলেন। সেখানেই কদিন আহার-নিদ্রা। হয়ত মৈথুন। আকাশ থেকে তো কিছু পড়বেনা, এক আকাশ ছাড়া! দুর্নিরীক্ষ উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একটা ঈগল, কচ্ছপের খোল ঠোঁটে নিয়ে। সেটা মাথায় এসে পড়ল। অত বড় নাট্যকারের তাতেই মৃত্যু হয়। আকাশ ব্যাপারে এ নিশ্চিন্ত যদিও এমনকি, পারস্যের সেই নিরক্ষর উপজাতি-প্রধানেরও ছিল না, তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাকে ভয় করো বিজেতা আলেকজান্ডারের এই প্রশ্নের উত্তরে অভিপ্রেত আলেকজান্ডার না বলে যে বলেছিল, আকাশ!
সত্যি, কার মাথায় কখন আকাশ ভেঙে পড়বে এবং কোথায় আর কীভাবে, আগে থেকে তা টের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জুতো পালিশ করতে করতে বা চুম্বন, কখন যে মারা যায়নি মানুষ! মন্দিরে-টয়লেটে কোথায় নয় যে। রোমের সম্রাট ক্লদিয়াসের দরবারে সম্রাটের কানে শব্দ ও নাকে গন্ধ যেতে পারে এই ভয়ে বাতকর্ম চেপে রাখতে রাখতে এক বিদূষকের বায়ু-চাপে হার্ট-স্ট্রোক হয়। দুহাতে বুক চেপে সে রাজসভায় লুটিয়ে পড়ে।
চুড়ান্ত অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়েছিল বটে বাদলের বড় পিসেমশায়ের। তিনি ছিলেন বামার লরির বিলেত-ফেরত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বেনেটোলার বাড়িটা বাদলের বাবা জলের দামে কিনে ফেললে, একদিন দেখতে এসে, সেদিন মহাঅষ্টমী, বুঝেছ উপেন, এই সিঁড়িটা বেশি দিন থাকবে না, এটা তাড়াতাড়ি সারিয়ে নিও এই না বলে বেড়াবার ছড়ি দিয়ে যেই একটা খোঁচা দিয়েছেন সিঁড়িতে, অমনি হুড়মুড় করে সেটা কিনা তাঁর মাথাতেই ভেঙে পড়ল! তাই বলছিলাম, অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু, এর কোনও জাত নেই। স্থান নেই। সময় নেই।
১ মে রাতের স্বপ্নে, গায়ে অ্যাপ্রন ও রক্তাক্ত গ্লাভস হাতে সিরিঞ্জ আমার দিকে তুলে ধরে রঞ্জন প্রশ্ন করেছিল, তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?
শিল্প-সাহিত্যে, কবিতায়, সময় কেমন এগিয়ে-পিছিয়ে যায়, কত অবলীলভাবে। সেখানে আগে থেকে জানা যায় কত কিছু। গীতার মূর্তিমান, জীবিত যুযুত্সবা: কত সহজে কুরুক্ষেত্রে আগে থেকে মরে পড়ে থাকে। অপরাহ্নে খুন হবে সান্তিয়াগো নাসার, তার রক্ত ক্রনিক অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড-এর পাতায় মধ্যাহ্নেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে। জীবনেও এমনটা হয়। হয়ে থাকে। কিন্তু, আগে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কেন যে।
দীঘা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। ২৬ এপ্রিল তখনও প্রায় তিন মাস দূরে। সেই অনাগত ২৬ এপ্রিলের ক্যালিফোর্নিয়ার রাত-উপকূলে জেগে উঠে নীল প্যাসিফিক ও পীতাভ দক্ষিণ চীন সমুদ্র পেরিয়ে, সরু মলাক্কা প্রণালীর মধ্যে দিয়ে চলে এসে, ভারত মহাসাগরও পিছনে ফেলে, বঙ্গোপসাগরের ঘোলা জলে যখন ঘাই মারল খুনে-খরশান সেই নীল ঢেউ, হাঁটু-জলে লাইফ বেল্টের ওপর সুমিতা তখন শুয়ে আছে। সুমিতা সাঁতার জানে না। তাই আমি আর লেদু আছি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। সে এসে প্রথমে তাকে উল্টে জলের মধ্যে ফেলে দিলে। এমন বিজাতীয় অর্বাচীন ঢেউ, যাতে এত নীলাভা, এত বড় ঢেউ, এখানে, তীরের এত কাছে আর এই শীতশেষের শুরুতে— দীঘার বেলাভূমিতে এ ছিল প্রায় কল্পনাতীত। আমরা দেখলাম, এক অ-দেখা নীল জলপ্রবাহের মধ্যে সে চিৎহয়ে শুয়ে। তা, এমন ঢেউ একটি বই তো না, সরে যেতে কসেকেন্ড দুই, চার, পাঁচ… আর কত। আমি তাই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। জানি, জল ভেঙে কাছে পৌঁছবার ঢের আগেই ও উঠে দাঁড়াল বলে। কিন্তু, এ কি অবিশ্বাস্য! সুমিতা ওঠবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করার আগেই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কোনাকুনিভাবে একবার এবং দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে কোনাকুনিভাবে আর একবার, দু-দুবার ফিরে এসে সে ওকে জলের নিচে চিৎ করে শুইয়ে রাখল। তারপর আর এল না।
এতক্ষণে আমি ওর পাশে চলে গেছি। সম্পূর্ণ সরে যাওয়ার আগে স্বচ্ছ-নীল সেই বিদেশি অপর-জলের মধ্যে আমি স্পষ্ট দেখলাম, মৃত্যুর পর যে হিমাভা ওর মুখে ছড়িয়ে থাকার কথা, তা এখনই ওখানে লেগে আছে। আজ যদি আমি বলি, গীতা বা ক্রনিক-এ যেমন, ২৬ এপ্রিল মার্সেদে ওর মৃত্যুর তিন মাস আগে আমি ওকে দীঘায় মৃত দেখেছি, তাহলে আমি একটুও মিথ্যে বলবনা।
তবু কেন যে বুঝতে পারিনি। কেন যে আগে বলে দিইনি, ওগো জীবন, তুমি সাবধান। তুমি মরে গেছ।
কেন যে।
মার্সেদের দিকে সোজা সড়ক ফ্রি-ওয়ে নাইনটি ওয়ান ছেড়ে কেন সে ১১৩ ধরে সানফ্রান্সিসকোর দিকে ওভাবে বেঁকে গেল, তা শুধু আমি জানি। আর জানত সে। সারপ্রাইজ দেবে বলে সে রঞ্জনকে কিছু বলেনি।
দীঘা থেকে ফেরার পথে, বাসে খুবই ক্যাজুয়ালি সুমিতা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছানদা, স্কেল-চেঞ্জিং হারমোনিয়ামগুলো কি আজকাল পাওয়া যায়, ওই যে-গুলো পোর্টেবল? একসময় ডোয়ার্কিন খুব এক্সপোর্ট করত। কী কিউট, না?
যাওয়ার আগের দিন দুপুরবেলা মানকুণ্ডু থেকে ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে ফিরে, বিছানার ওপর, দরজা খুলেই, নতুন, এক্সপোর্ট-কোয়ালিটি, পোর্টেবল হারমোনিয়ামটি দেখতে পেয়ে সে কী উন্মাদনা তার মুখে-চোখে! মন্ত্রচালিতেরমতো হেঁটে গিয়ে, একেবারে কোলেটোলে তুলে নিয়ে সেটা, স্টপারগুলো খুলে ও বন্ধ করে, কী ক্ষিপ্রতায় সে সরগমে ভরিয়ে তুলল তার ঊর্ধ্ব ও অধঃ চেম্বার যখন জ্ঞান ঘোষের গ্রেন ও বন্দিশ পেরিয়ে এসে ঝরে পড়তে লাগল তার হাস্কি গলা থেকে: গোলাপ জানে, বকুল জানে
মঞ্জরী আর মুকুল জানে
মোর গগনে কোন ফাগুনে
হেসেছিল কোন সে রাগিণী…