তোর মেয়ের বিয়ে দিবি কী করে? টাকা পাবি কোথায়? ওখানে তো ডাওরি লাগে?
ওহ। ইউ ইনকরিজিবুল হামবাগ। ইউ ভেইন! ইউ ফুল! তা যদি লাগে, শি উইল প্রস্টিটিউট হারসেলফ, কালেক্ট দা মানি অ্যান্ড প্রেজেন্ট দা ডাওরি টু হার হাজবন্ড। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?
আমি ডাক্তার। আমি মানুষ বাঁচাই। হোয়াট ডু ইউ ডু?
আ। ফর ওয়ন্স ডোন্ট বি আ হিপোক্রিট। সত্যি করে বল তো, তুই ডাক্তার, না, ব্যবসাদার? ডাক্তারের গাইডিং ফোর্স তো দুটো। এক, জ্ঞান। দুই, রোগীকে সারিয়ে তোলা। এর মধ্যে ব্যবসা আসে কোথা থেকে রে? কেন ওই অৰ্চাৰ্ড, গোল্ড মাইনের অর্ধেকটা কিনেছিস কেন, কেন ১৪টা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়েছিস?তই ছেলের জন্যে কত রেখে গেছিস?দশমিলিয়ন, কড়ি মিলিয়ন? তোদের শোবার ঘরে নিউ ওয়েভার্স জাজ বাজিয়ে, ইউ নো হোয়াট…তোদের বিছানায়। হ্যামলেট মাকে বলেছিল, এখনও তোমার বিছানা থেকে বাবার বীর্য শুকোয়নি তুমি এর মধ্যে কাকার সঙ্গে ওই বিছানায় শুলে? ফ্রেয়লটি, দাই নেম ইজ… এ তো সেই বৃত্তান্ত। তারা এর নাম ছেলেকে এডুকেশন দিচ্ছিলিস? এ তো আমেরিকান জন্তু একটা। আরন্ট ইউ অ্যাশেমড় অফ আ সন লাইব দ্যাট—স্বীকার কর হতভাগা। যে ব্যর্থ যদি কেউ হয়ে থাকে, সে তুই। আমি নয়। তুই! তুই!
ন’দা! আমি তোকে চিরকাল আমার অলটার-ইগো ভেবেছি। আমি যখন ডাক্তারি পড়তাম, তখন আমার বাক্স থেকে হাড়, মাথার খুলি এ-সব তুই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি। মার্কাস স্কোয়্যারের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তোদের অতি আধুনিকা বলে বই-এর দোকানে কবিতার বইএর পেপার ওয়েট হিসেবে এগুলো ব্যবহার করেছিলি। আমি কত রাগ করেছিলাম, মনে আছে?
একদিন লুকিয়ে তোর শার্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। তুই জামাটা আমার গা থেকে খুলে নিয়েছিলি। সেদিন আমি মার্কাস স্কোয়্যারে গিয়েছিলাম গেঞ্জি পরে।
আমাদের তো ক্লাস ফোর অবধি খালিশা। নটি বয় পেলাম ফাইভে উঠে। প্রথম মোজা পরে মেডিকেল কলেজে যাই।
ক্লাস ফোর অবধি খালি পা। ঠিকই। কিন্তু আমাদের সেজন্যে কোনও অভাববোধ ছিল কী?
না… তা…তখন…।
দেয়ার ইউ আর! এই অভাববোধের অভাব— এ যতদিন বেঁচে থাকবে মানুষের মনে— যতদিন, যাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে–যতদিন শিশু বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে—ততদিন সে তার কাছ থেকে এটা শিখবেই—ততদিন অ্যাচিভমেন্ট বলতে সে অন্য জিনিস ভাববে। আর, তুই যা করেছিস, তাকে মনে হবে এলিফ্যান্ট-শিট!
ব্লেসেড ইজ দা পুওর ইন স্পিরিট?
ব্রেসেড ইজ দা চাইল্ড ইন স্পিরিট!
…
তোকে টি. এস. এলিয়টের একটা বই পাঠিয়েছিলাম। পাতা উল্টে দেখেছিলিস?
না। সময় পাইনি।
আহা, অন্তত দ্য বেরিয়াল অফ দা ডেড-এর এই কটা লাইনও যদি, যদি তুই পড়তিস, যাতে ছিল…
Unreal City
Under the brown fog of winter dawn
A crowd flowed over London Bridge.
So many
I had not thought
Death had undone so many…
তুই একবার পাতা উল্টেও দেখলি না বইটার?
অথচ, আমি পাঠিয়েছিলাম! তাহলে তো তুই তখনই জানতে পারতিস সেই সব জিনিসের কথা যাদের অস্তিত্ব আছে। যাদের অস্বীকার করা যায় না। যারা তোর মনোযোগ দাবি করে।
কী অ-ব্যর্থভাবে মরে গেলাম না রে ন’দা?
…
আমাদের বেনেটোলার বাড়ির গোলবারান্দা থেকে আমরা কাগজের প্লেন ছাড়তাম, তোর মনে পড়ে?
হ্যাঁ। আমারটা আগে মুখ থুবড়ে পড়ত।
আচ্ছা, আমি কেন এভাবে বেঘোরে মারা গেলাম, তুই জানিস?
…
বল্ না। আমি অশিক্ষিত। এলিয়ট পড়িনি। তুই বল আমাকে।
আমি এতক্ষণ তো সেই কথাই বললাম।
এলিয়ট পড়িনি, তাই। না রে, নদা?
দ্যাখ, মৃত্যু হল আমি বেঁচেছিলাম এই মুখোশটার খসে পড়া। এ ছাড়া কিছু তো নয়। মুখোশটাকে তুই মুখ ভাবতে গেলি কেন রে রুনু?
জীয়ন মরে গেল কেন?
…
ওইটুকুন ছেলে। ওর অপরাধ কী?
জানি না।
আই হ্যাভ আ হাঞ্চ। ওকে অবিকল আমার মতো দেখতে হয়েছিল। হয়ত তাই। রাইট?
আমি জানি না।
আর সুমিতা
আমি জানি না।
সহমরণে যাবে বলে নিশ্চয় নয়? বল না! আই হ্যাভ আ হাঞ্চ।
…
হোয়াট হ্যাপেন্ড অ্যাট দীঘা?
আমি জানি না।
সুমিতা আমাকে সানফ্রান্সিসকো নিয়ে যাচ্ছিল কেন? বলল, চল না, হেভি সারপ্রাইজ দেব তোমাকে। নইলে তো আমরা ৯১ নং ফ্রি-ওয়ে ধরে ফিরতাম। তুই জানিস কেন?
আমি জানি না।
১৫. এসকাইলাসের মৃত্যু ও অন্যান্য
১০ মে।
আজকের ডাকে রঞ্জনের একটা চিঠি এসেছে। জবৃলপুর থেকে ছোড়দির লেখা। ভাই রুনু ছোড়দি লিখেছে, ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল শেষরাতে তোর জন্ম। সেদিন দারুণ ঝড়বৃষ্টি। বেলার দিকে হৃষীকেশ থেকে এতোয়ারি বাবা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। হুলুস্থুল কাণ্ড। কদিন থেকেও গেলেন সেবারে। তোর কুষ্ঠি তৈরি করে দিলেন। বলে গিয়েছিলেন, এই ছেলের ৭ মাসে, ১৭ বছরে আর ৪৯ বছরে মৃত্যুযোগ আছে। ৪৯ পেরুলে এ জাতক রাজা হবে। ৭ মাসে কাচকামিনীদের বাড়ির পুকুর থেকে তোকে প্রায় মতই ভোলা হয়। সবাই তাই ভেবেছিল। ঠিক ১৭ বছর বয়সে হয়েছিল সাঙ্ঘাতিক পেরিটোনাইটিস। অপারেশনের পর ওই অসুখ হলে তখন কেউ বাঁচত না। এ বছর ২১ এপ্রিল তোর ৪৯ পূর্ণ হয়ে গেল। যাঃ তাহলে তুই বেঁচেই গেলি শেষ পর্যন্ত। প্রার্থনা করি, আমাদের স্বর্গীয় পরমারাধ্য কুলগুরুর কথার বাকিটাও ফলুক। তুই রাজা হ।
আমি জ্যোতিষে বিশ্বাস করি না। তবে, এই একটি ক্ষেত্রে দুর্বলতা হয়। ইচ্ছে হয় ভাবি যে, ওর জন্মমুহূর্তটি হয়ত অব্যর্থভাবে বলা যায়নি, তাই ৫ দিন এদিক-ওদিক…এমন ভাবনার শৌখিনতাকে প্রশ্রয় দিতে মন চায়, যদিও, আমি জানি, অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু, তার কোনও যথাস্থান নেই, নেই কোনও যথাসময়, সে-আবহাওয়ার কোনও পূর্বাভাস থাকতে পারে না। অন্তত মৃত যারা তাদের কাছে তো নয়ই। দুর্ঘটনায় যারা মারা যায়, তারা দেশে মরে না। বিদেশেও মরে না। তারা রাত ৯টায় মরে না, বা ভোর ৬টায় মরে না। পৃথিবীর দেশ-বিদেশ বা পৃথিবীর সময় তাদের পক্ষে প্রযোজ্য হয় না।