সে আর তার বৌ এবং মেয়ে ন্যান্সি শ্রাদ্ধে যেতে চায়। কারণ, এখানে ছিল না বলে ফিউনারালে যেতে পারেনি। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায়।
লোকটা এ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ বলতে লোকটা খুবই রোগা।
রোগা আমেরিকান… আমার মনে পড়ল, প্রথম মোর্নার হিসেবে সবার আগে বাড়িতে এসেছিল এই হ্যারি না?
মাই ডটার ন্যান্সি অ্যান্ড জন আর গুড ফ্রেন্ডস।
জন বলতে অঞ্জন। সাহেবরা ওকে জন বলে ডাকে।
৮ মে।
বিকেলবেলা। ছোট্ট এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। হোয়াইট গেট ড্রাইভ জুড়ে যতদূর দেখা যায় বৃষ্টি শেষের কনে-দেখা-আলো।
রাস্তার দুধারে একই জাতের তরু-বীথিকা। তাতে কাঠগোলাপের মতো সাদা সাদা ফুল।
সারা পথ জুড়ে সেই দুপুর থেকে এখনও কোনও পথিকের দেখা নেই। হাওয়া নেই। শুধু মাঝে মাঝে গাড়ি গেছে নিঃশব্দে।
একটু আগে সুন্দর তামার ঘটে রঞ্জন, সুমিতা, আর জীয়নের অ্যাসেস দিয়ে গেছে।
সারা রাস্তায়, পথের মাঝামাঝি একটা ঝকঝকে নীল অটোমোবাইল দাঁড়িয়ে।
লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল?
১৪. রঞ্জনের সঙ্গে কথাবার্তা
৯ মে।
কীরে নদা, সেই এলি তাহলে?
……
খুব ভাল লাগছে। ব, কেমন দেখছিস আমার ঘরবাড়ি?
ঠিকই আছে।
ঠিক আছে কীরে। ওই যেখানে পাহাড়ের শুরু, ওই পর্যন্ত সবটা আমার।
আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি।
সে কীরে। এ কথা বলার স্পর্ধা তোর হয় কী করে। নে একটা কমলা লেবু খা।
না।
আরে, খা না!
না।
না?… এই যে ঘড়িটা পরে আছি, এটার দাম কত জানিস?
ন্না তো।
এগুলো জেনিভার পেজেঘড়ি। গত ৫ বছরে এরা এই মডেলটা মাত্র ১৭৫টা তৈরি করেছে। আমি পরে আছি ১৫৫ নং ঘড়িটা। দ্যাখ, নম্বর লেখা আছে। এর দাম কত জানিস? ১৯ হাজার ১শো ৬০ ডলার। রাফলি ১৪ দিয়ে গুণ কর। লাখ তিনেক টাকা হবে আর কী। আমার আর একটা পেজে আছে। হোয়াইট গোল্ডের। ডায়মন্ড সেট করা। ৮০ হাজার ডলার দাম। ওটা আছে এল-এ-র ফাইডেলিটি ব্যাঙ্কের ভল্টে ডু ইউ নো হাউ মাচ রিয়েল এস্টেট আই ওন— ওয়ার্দি অফ হাউ মেনি ডলার্স। হাউ মাচ ইন ক্যাশ? টেন মিলিয়ন, টুয়েন্টি, থার্টি-ট্রাই টু গেস…
আমি জানি না।
ও-কে। ইয়া। বাট দে আর দেয়ার। ওয়েল, ইউ কান্ট পসিবলি ডিসপিউট দেম। ক্যান ইউ? ইউ ক্যান নট আউট দা থিস দ্যাট একজিস্ট, দো দে আর বিয়ন্ড ইউ। ও-কে? তোর ফ্ল্যাট কত বড়?
সাড়ে ছ-শো।
কিনতে পেরেছিস?”
না।
ব্যাঙ্কে কত?
আমার এখন বিশ হাজার টাকার মতো ধার।
আমি টিকিট পাঠালাম। এলি না! আই শ্যাল বায় ইউ দা রিটার্ন প্যাসেজ এনিওয়ে।
আমার জুতোর ঘরে ঢুকেছিলি?
হ্যাঁ।
ক-জোড়া জুতো ওখানে জানিস। জানিস না। ৮০ জোড়া। তোর?
আমার এক জোড়া জুতো।
মোজা এক জোড়া?
হ্যাঁ।
এই যে জামাটা পরে আছি, ম্যানুফ্যাকচারারের নাম জানিস?
না।
গুচে। বছরে ৫০০ শার্ট বানায়। এর যে ইজিপসিয়ান কটন, এরা নিজেরা তৈরি করে। আমার বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে— সোলার প্ল্যান্ট, নিজের জেনারেটর যা ওই উইন্ডমিল তৈরি করে—৭২ ফিটের সুইমিং পুল—একে বলে জাকুসি। এতে পর পর দুটো ডুব মারলে, একটা ঠাণ্ডা আর একটা গরম—লোকে বাপের নাম ভুলে যায়, বুঝলি? তুই আমার লিভিংরুমে যা কিছু দেখলি এভরি বিট অফ ইট ইজ ফ্রম ক্যাশমিয়ের। অলটুগেদার বাড়িটার দাম কত জানিস? কিনেছিলাম দেড় মিলিয়নে। মানে দুকোটি আর কি। কিন্তু এখন? কতটা জমি, তোর ধারণা? বাহান্ন বিঘে। তুই আবার হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান রিকোয়ার গল্পটা শোনাবি না তো? হ্যাঃ, হ্যাঃ, হ্যাঃ।
কিন্তু, আমি তো ঠিক তাই শোনাব। আমি তো দেখছি তুই একটা কয়েদী?
ডোন্ট বি সিলি।
হ্যাঁ। অ্যান্ড ফর ইওর হোল লাইফ টার্ম অ্যাট দ্যাট।
কী রকম?
দ্যাখ যখন এয়ারপোর্টের বেড়ার ওপার থেকে দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে আর ঝকঝকে বৌ-এর কনুই ধরে এগিয়ে আসতিস… প্রথমবার এসে কী বলেছিলি মনে আছে?
কী বলেছিলাম বল তো? এত রোগা আর ইমাসিয়েটেড, কীরে, তোরা কি খেতে পাস না?
রাইট। এখন এখানে তোকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। অবশ্য, এভরিবডি নোজ হিয়ার দ্যাট ইউ আর আ রাইটার। কাজেই, তোর মতো চেহারাটাও কোয়ালিটেটিভলি চলে যাবে। হ্যাঁ, লাইফটার্মের ব্যাপারটা কী বলছিলি বল তো?
কী বলছিলাম…আ-হা, এয়ারপোর্টে তোদের দেখে দেশে ও-রকম মনে হত। মনে হত স্বর্গ থেকে আসছিস। ভাবতাম, কেন ফিরবি তোরা এই হতভাগা দেশে, এই পৃথিবীতে?
আর এসে কী দেখছিস?
দ্যাখ, আগে যদি আসতাম, আমি ঢের হয়েছে এখন চল তো বলে বোঁচকা-কুঁচকি তুলে তোদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। হ্যাঁ, সম্ভব হলে ঘাড় ধরে। তোরা টাকার গাছ পুঁতেছিস বটে একটা। কিন্তু, তার চারদিকে জেলখানার দেওয়াল। ইয়েস, ইউ আর সার্ভিং লাইফ। ফর শিওর!
অ্যাই…স্টপ দ্যাট বুলশিট।
নো আই অ্যাম টেলিং ইউ হোয়াট ইউ রিয়েলি আর। দ্য ট্রুথ!
তুই তোর মেয়ের ফিউচারের জন্যে, বৌদির জন্যে কী করেছিস? ইউ ইরেসপনসিবল প্যারাসাইট! মেয়েটার ভবিষ্যতের ভার পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিলি!
আমি জানতাম না। ভেবেছিলাম তোরা একটা-কিছু। ইউ হ্যাভ অ্যাচিভড সামথিং। এসে দেখছি, এই বাড়িঘর, গাড়ি, অৰ্চাৰ্ড, সুইমিং পুল…এ তো বনে ফিরে যাওয়া একটা হাতির নাদা, কাঁচা কয়লার উনুন থেকে উড়ন্ত ধোঁয়ার চেয়েও বেশি ধোঁয়া বেরচ্ছে এ-থেকে। ইউ রিয়েলি হ্যাভ অ্যাচিভড নাথিং।
রিয়েলি?
হ্যাঁ। অন্তত একবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। শুধু নিজের সংসারের শ্রীবৃদ্ধি করা কোনও অ্যাচিভমেন্ট নয়। এর বাইরে অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে যা আমাদের প্রত্যেকের সত্ত্বা-আমাদের প্রত্যেকের সেলফ জানে। সে কথা ভুলে মেরে দিয়ে শুধু নিজের সংসারের বেঁচে থাকাকে নিজের বেঁচে-থাকা ভাবা… সংসার ছেড়ে, বৌকে ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে তুই চলে যেতে পারিস। মানুষ যায়। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে তুই কোথায় যাবি?